শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
রকিব রেজা ফিচার ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ৪:২৪ অপরাহ্ন
শেয়ার

নিজেকে প্রকাশের আগে মাথায় রাখুন ৭ বিষয়


7 things to think

তাই নিজের পরিকল্পনা, কাজ, অনুভূতি বা সাফল্য সম্পর্কে কাউকে কিছু বলার আগে, এক মুহূর্ত থামুন, চিন্তা করুন

অনেক দিন আগে আমি একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের কথা বলছি। আকস্মিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। একসঙ্গে প্রায় ৬ হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। আমরা অনেকেই পড়ি অথৈ জলে। সে সময় আমার জানাশোনা ছিলো কম, নেটওয়ার্ক ছিলো খুবই ছোট। এমনকি অন্য কোনো সংস্থার নাম জানতাম না। তেমন কাউকে চিনতাম না। সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ খারাপ ছিলো।

একদিন এক শুভাকাঙ্খির সাথে দেখা। বয়স ও অবস্থানে আমার সিনিয়র। তিনি জানতে চাইলেন কেমন আছি। আমি তাকে বলেছিলাম, ভালো নেই, চাকরি নেই, এসব কথা। তিনি খুবই মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন সেসময়। বলেছিলেন, খারাপ আছো এটা কাউকে বেশি বেশি বলবে না, কারণ বেশিরভাগ মানুষ (সবাই না) উপকার তো করবেই না বরং আড়ালে বলবে নানা ধরনের আজেবাজে কথা। যেমন, ও বেকার হবে না তো কে হবে, নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করেছে, ও মানুষের সাথে ডিলিং জানতো না, ওর কথা ভালো না (যদি ভালো হয়ও), নানা কিছু আর কী। তার চাইতে ‘এই বেশ ভালো আছি’ নীতিতে চলাই ভালো । আর নিজের ক্যাপাসিটি বাড়ানো, স্ট্রেন্থ বাড়ানো, নেটওয়ার্ক এর বিস্তার ঘটানো এসব দিকে মনোনিবেশ করা ভালো।

তাই নিজের পরিকল্পনা, কাজ, অনুভূতি বা সাফল্য সম্পর্কে কাউকে কিছু বলার আগে, এক মুহূর্ত থামুন, চিন্তা করুন, নিঃশ্বাস নিন, নিজেকে প্রশ্ন করুন- ‌‘আমি যা অন্যজনের সাথে বলেত যাচ্ছি তা কি সত্যিই বলা দরকার?’

আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করি, যেখানে অতিরিক্ত শেয়ার করা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, সাধারণ আলাপচারিতা থেকে শুরু করে —জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি প্রকাশ করা এখন খুব সহজ।
কিন্তু তাই বলে সবকিছুই শেয়ার করতে হবে—এমন নয়।

মাইন্ডফুলনেস অনুশীলনকারীরা বলেন, শান্তি অনেক সময়ই আসে সংযম থেকে, নীরব আত্মবিশ্বাস থেকে। মাইন্ডফুলনেস শেখায়, কিছু বলার আগে থামতে হয়, ভাবতে হয়- ‘যা বলতে যাচ্ছি, তা কি দরকারী? তা কি উপকারী? তা কি প্রয়োজনীয়?’ অধিকাংশ সময়ই যার উত্তর—না।

এখানে এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো, যা মাইন্ডফুল এবং সচেতন মানুষ সাধারণত ব্যক্তিগতই রাখেন।

নিজের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য
লক্ষ্য নিয়ে একটি অদ্ভুত সত্য হলো, যত বেশি আপনি এগুলো নিয়ে অন্যের সাথে আলাপ-আলোচনা করবেন, মানে বেশি প্রচার করবেন, এগুলো পূরণের সম্ভাবনা তত কমে যাবে।

গবেষণা বলছে, অনেক আগে থেকে, লক্ষ্যপূরণ নিয়ে বেশি প্রচার করলে আমাদের মস্তিষ্ক সাময়িক এক ধরনের ‘সাফল্যের অনুভূতি’ পায় যে, সাফল্যের পথে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। এই সামান্য স্বীকৃতিই আসল কাজের প্রতি আমাদের অনুপ্রেরণা কমিয়ে দিতে পারে।

আমার এক পরিচিত যিনি সবাইকে বলে বেড়াতেন যে, তিনি বুলগেরিয়া চলে যাচ্ছেন। মানে তার জীবেনর একটা বড় লক্ষ্য ছিলো, বিদেশে যাওয়া। এই কথা তিনি সবাইকে বলতেন। প্রায়ই বলতেন, ব্রিটিশ কউন্সিলে ইংরেজি শিখছেন, আইএলটিইএস দেবেন, ড্রাইভিং শিখছেন ইত্যাদি। এসব তিনি সবাইকে সব সময় বলতেন। পরিস্থিতি এমন হলো যে, অফিসের ড্রাইভার সাহেবরা তাকে আড়ালে আবডালে বুলগেরিয়ান স্যার বলে ডাকতে লাগলো।

শেষ পর্যন্ত তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তিনি বুলগেরিয়া যেতে পারেননি। কেন যেতে পারেননি, তার কারণও জানা যায়নি। যাওয়ার আগ পর্যন্ত যদি তিনি সবাইকে বিষয়টা না বলতেন, তাহলে আর এসব নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ থাকতো না। তাই নিজের লক্ষ্য নিয়ে মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করে এগিয়ে যাওয়া, লক্ষ্যে স্থির থাকা, সহায়তা দরকার হলে সঠিক মানুষের কাছে চাওয়া, এগুলো করা দরকার।

মাইন্ডফুল মানুষেরা তাই নীরবে কাজ করেন, ফলাফলই তাদের হয়ে কথা বলে।

সব স্বপ্ন দর্শককে আগেই দেখাতে হবে এমন কোনো কথা নেই, কিছু স্বপ্ন পূরণের জন্য নীরবতা প্রয়োজন হয়।
আপনার লক্ষ্যকে একান্তে লালন করুন, যতক্ষণ না তা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

সেবামূলক কাজ
অনেকেই দান, সহায়তা বা সেবামূলক কাজগুলো প্রকাশ্যে করেন এবং অনলাইনে তা শেয়ার দেন। কিন্তু দয়া যখন দেখানোর বিষয় হয়ে ওঠে, তখন তার আধ্যাত্মিক শক্তি কমে যায়। ধর্মে বলা হয়েছে, ডান হাত দিয়ে দান করলে, বাম হাত যেন টের না পায়।

মাইন্ডফুলনেস শেখায়—সবচেয়ে খাঁটি দান হলো সেটা, যার বিনিময়ে কোনো কিছু প্রত্যাশা করা হয়না। নীরবে কাউকে সাহায্য করলে নিজের ভেতরের দরদ বৃদ্ধি পায়, অহং বোধ নয়।

সত্যিকারের মহত্বের জন্য হাততালির প্রয়োজন নেই—সার্থকতা লুকিয়ে থাকে কাজের মধ্যেই। ভালো কিছু করুন, ভালো কাজ করা দেখানোর বিষয় নয়, বরং এটা আপানার সাথেই আছে।

ব্যক্তিগত সংগ্রাম
মানুষ যখন অসুবিধার মধ্যে থাকে সেই সুবিধাহীনতাও তাকে শক্তি দিতে পারে—কিন্তু সে ক্ষেত্রে সময়টি কখন তা গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে আপনার রক্তাক্ত ক্ষতের কথা বলবেন, না কীভাবে সেরে উঠলো সেই ক্ষত, তা নিয়ে জানাবেন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।

কোনো কষ্টের কথা খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেললে, তা থেকে বের হয়ে ওঠার যে মুহূর্ত, তার বদলে মনে হয় আপনি কষ্টের গল্পের ব্যাপারে স্বীকৃতি পাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন।

মাইন্ডফুলনেস শেখায়—কষ্টের কথা অন্যকে বলার আগে, কষ্টের সঙ্গে বসতে, তাকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করতে, বুঝতে এবং কীভাবে পার হতে হবে এসব নিয়ে ভাবতে। এর মানে অনুভূতি দমন করা নয়—বরং অনুভূতিকে একান্তে যত্ন করে ধারণ করা, যতক্ষণ না তা জ্ঞান হয়ে ওঠে।

যখন কোনো ঘটনার সমাধান হয়ে যায়, তখন আপনার সেই গল্প অন্যকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তার আগে, প্রয়োজন ঘটনাকে অযথা প্রকাশ না করে একান্তে গোপন রাখা।

যারা অনেক কষ্ট করে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের জীবনের কষ্টের গল্প আমরা পড়ি। পড়তে ভালোলাগে, কিন্তু তারা যদি ঐসময় কষ্টগুলো বলে বেড়াতেন তাহলে নিশ্চয়ই ভালোলাগতো না।

পারিবারিক সমস্যা
প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু জটিলতা বা অসন্তুষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু মাইন্ডফুল মানুষগণ সেই সমস্যাগুলো প্রকাশ্যে আনেন না, এমনকি “শুধু অভিযোগ” করার উদ্দেশ্যেও নয়।

পারিবারিক সংকটগুলো জটিল, ব্যক্তিগত ও আবেগপূর্ণ। হেলাফেলায় তা প্রকাশ করা হলে এটি সমাধানের চাইতে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। পারিবারিক সমস্যাগুলো ব্যক্তিগতভাবে রাখা মানে এই নয় যে আপনি ভানিতা করছেন, যে সমস্যাগুলো নিখুঁত—বরং সমস্যা প্রকাশ না করে আপনি যারা এর সাথে জড়িত, তাদের সম্মান করছেন, এমনকি তারা যদি জটিল হয় তাও।

শান্তি আসে বিচক্ষণতা থেকে, আর আরোগ্য আসে সহমর্মিতা থেকে। কষ্ট সামলাতে হলে, তা করতে হবে নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশে—জনতার মঞ্চে নয়।

আর্থিক অবস্থা
অর্থিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা, খুব খারাপ কিছু বয়ে আনতে পারে- মানুষের মধ্যে হিংসা, অনিরাপত্তা, তুলনা, অথবা বিরূপতা সৃষ্টি করতে পারে।

তাই মাইন্ডফুল মানুষেরা তাদের আয়, সঞ্চয় বা বিনিয়োগ নিয়ে খুব সতর্কতার সাথে বাছাই করে তথ্য শেয়ার করেন। তারা আর্থিক অবস্থা একান্তে রাখতে চান এমন নয়, বরং আর্থিক তথ্য অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এটি ব্যক্তিগত রাখলে মানসিক শান্তি, অযথা প্রতিযোগিতা এবং চাপ মুক্ত থাকা যায়।

মাইন্ডফুলনেস, আপনার সম্পদের সংজ্ঞা আপনাকেই দিতে বলে, অন্যেরা আপনার সম্পদ নিয়ে মতামত দেবে, তুলনা করবে, এটা নয়। ব্যাংক ব্যালেন্স আপনার মর্যাদা নির্ধারণ করে না। কিন্তু এ নিয়ে অতিরিক্ত কথা বললে মনে হতে পারে যেন এটাই আপনার মাপকাঠি।

আপনার সম্পর্ক
আজকের সামাজিক মাধ্যমে সম্পর্কের প্রতিটি মুহূর্ত প্রকাশ করা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্ককে ব‍্যক্তিগত ও একান্তে রাখার প্রয়োজন আছে। গোপন রাখা নয় বরং সংরক্ষিত রাখা।

সম্পর্কের খুঁটিনাটি বারবার প্রকাশ করতে থাকলে, আপনার একান্ত বিষয়ে অন্য মানুষদের পছন্দ, মন্তব্য, প্রত্যাশা, এসব চলে আসে।

ভালোবাসার সাফল্য প্রদর্শনীতে নয়। ভালোবাসা অনুভব করার বিষয়, প্রমাণ করার নয়। সুন্দর সম্পর্ক নীরবে বেড়ে ওঠে, বাহ্যিক স্বীকৃতির হৈ চৈ ছাড়াই। আনন্দ শেয়ার করুন, প্রমাণ নয়। সম্পর্ক হোক অনুভবের, প্রচারের নয়।

আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ
নিজের পরিকল্পনা, কৌশল বা পরবর্তী পদক্ষেপ সবসময় প্রকাশ না করার মধ্যে এক ধরনের নীরব শক্তি আছে। মাইন্ডফুল মানুষ জানেন—কখনো কখনো স্থিরতাই কৌশল। নীরবতাই অগ্রগতি।

আসন্ন সব পরিকল্পনা অন্যদের কাছে প্রকাশ করলে আপনি বাইরের মানুষকে মতামত দিতে, আপত্তি জানাতে বা অনিচ্ছাকৃত বাধা দেওয়ার জন্য দরজা খুলে দিচ্ছেন। যেমন বলা হয়- ‘কঠোর পরিশ্রম করুন নীরবে; সাফল্য নিজেই আওয়াজ তুলবে।’

আপনার শক্তি বাড়ে সেখানে, যেখানে আপনি মনোযোগ দেন। বাস্তবে রূপ নেওয়া পর্যন্ত সেই শক্তিকে রক্ষা করুন।

মূল শিক্ষা
মাইন্ডফুলনেসের কেন্দ্রে আছে আত্মসম্মান বোধ—সবকিছুই যে শেয়ার করতে, ব্যাখ্যা করতে বা প্রমাণ করতে হয় না, সেই উপলদ্ধি।

কিছু বিষয় ব্যক্তিগত রাখলে—উন্নতি, সম্পর্ক এবং শান্তির চাবিকাঠি নিজের কাছে থাকে।

এটি গোপনীয়তা নয়—এটি স্বাধিকার। আপনি কিছু লুকাচ্ছেন না; বরং ঠিক করে দিচ্ছেন কোথায় আপনার জীবনের সীমা শেষ এবং পৃথিবীর শুরু।

কারণ যত বেশি আপনি নিজের ব্যক্তিগত বিষয় উন্মুক্ত করে দেবেন, তত বেশি ভঙ্গুর হয়ে যাবেন। আর যত বেশি আপনি নিজের ভেতরটা রক্ষা করবেন, তত বেশি শান্তি অনুভব করবেন।

সবাই যদি আপনার সবকিছু বুঝে ফেলে তাতে শান্তি নেই—শান্তি আসে নিজেকে গভীরভাবে উপলব্ধীর মাধ্যমে।

মূল লেখা: ল্যাকলান ব্রাউন, ভেগআউট নিউজলেটার