শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
নিয়াজ মাহমুদ সাকিব ফিচার ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৬:৫১ অপরাহ্ন
শেয়ার

কৌতূহলের ইতিহাস: সক্রেটিস থেকে সার্চ ইঞ্জিন


Curiosity Cover

কৌতূহল থেকেই প্রজ্ঞার সূচনা– সক্রেটিস

প্রশ্ন! 
মানবসভ্যতার সবচেয়ে পুরোনো ও বিপজ্জনক অভ্যাস- প্রশ্ন তোলা।
কারণ, প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিপ্লব আর অগ্রগতির সূচনা কিংবা বিদ্রোহের বীজ কিংবা প্রশ্ন থেকেই হয় নতুন কোনো চিন্তার জন্ম।
প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস যখন রাস্তায়-রাস্তায় তরুণদের জিজ্ঞেস করতেন- “তুমি কি জানো, আসলে তুমি কী জানো না?”-
এই তো এভাবেই শুরু মানুষের কৌতূহলকে দর্শনের মঞ্চে তোলার ইতিহাস। এই এক প্রশ্নোন্মুখতা থেকেই জন্ম নেয় যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, গণতন্ত্র।
কৌতূহল তখনও ছিল বিপজ্জনক, কিন্তু সভ্যতার ইন্ধন পাওয়ার যোগসূত্রের উৎপত্তিটা এভাবেই- কৌতূহল থেকেই।

কৌতূহল বনাম শিক্ষা: যে লড়াই আজও থামেনি
Ian Leslie তাঁর বই Curious: The Desire to Know and Why Your Future Depends on It-এ বলেছেন, “Curiosity is fragile; it needs freedom, not fear.”
আজকের দুনিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা যতো বেশি পরীক্ষানির্ভর হচ্ছে, ততোই যেন কমছে প্রশ্ন করার সাহস। কৌতূহলী হওয়া কিংবা প্রশ্ন করার স্পৃহা যেন ক্রমশই কমে আসছে।
কখনও কখনও দেশে দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ধরনের ত্রুটি থাকতে পারে, কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক সময় শেখায়—“উত্তর মুখস্থ করো”,
কিন্তু কৌতূহল শেখায়—“প্রশ্ন করো- কেন? কেন এভাবে? কেন এমন হতে হবে?”
Stanford Encyclopedia of Philosophy-তে বলা হয়েছে, কৌতূহল শুধু তথ্যের ক্ষুধা নয়, এটি নৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক শক্তি।
যা মানুষকে অজানার প্রতি নতজানু করে, আবার চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দেয়।
একজন বিজ্ঞানীর প্রথম প্রশ্ন- “কেন?”
একজন দার্শনিকের—“কীভাবে জানি আমরা?”
আর একজন শিশুর—“কেন আকাশ নীল?”
এই তিনটি প্রশ্নেরই উৎস একই- কৌতূহল।

Corosity Inner 2
সক্রেটিসের মৃত্যুও এই প্রশ্ন তোলার কারণেই।
সক্রেটিসের মৃত্যুর কারণ সরাসরি শুধু এবং শুধুমাত্র একটি ‌‘প্রশ্ন’ ছিল না, বরং তাঁর প্রশ্ন তোলার দর্শনই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তৎকালীন শাসকদের পছন্দ হয়নি সক্রেটিসকে। কারণ তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নগুলো বারবার তৎকালীন সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো।
তার দর্শন, প্রশ্ন উত্থাপন পদ্ধতি এবং তৎকালীন এথেনীয় সমাজের মূল্যবোধ ও কর্তৃপক্ষের প্রতি তার সমালোচনামূলক মনোভাবের সামগ্রিক ফল ছিল তাঁর মৃত্যু।

Corosity Inner 1

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছিল, সেগুলো হলো:
১. দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ (Impiety/Asebeia): অর্থাৎ, তিনি এথেন্সের স্বীকৃত দেবতাদের মানতেন না এবং নতুন দেবত্বের প্রচলন করছেন।
২. এথেন্সের যুবসমাজকে বিপথে চালিত করা (Corrupting the Youth): অর্থাৎ, তিনি তরুণদের প্রচলিত মূল্যবোধ ও কর্তৃপক্ষকে অশ্রদ্ধা করতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।

আসলে যা ঘটেছিল:
প্রশ্ন করার পদ্ধতি (Socratic Method): সক্রেটিস বাজারের রাস্তায় বা জনসমক্ষে সমাজের প্রভাবশালী ও জ্ঞানী বলে পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি এমন প্রশ্ন করতেন যার মাধ্যমে তাদের নিজেদের জ্ঞানের অভাব বা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিহীনতা প্রকাশ পেয়ে যেতো। এই পদ্ধতিই (Socratic Method) সমাজে অনেক শত্রু তৈরি করেছিলো।

কর্তৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ: তিনি তরুণদেরকে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখাতেন- প্রচলিত আইন, সরকার এবং প্রথাগত দেবতাদের বিশ্বাস, সবকিছু! একটি সদ্য পুনরুদ্ধার হওয়া গণতন্ত্রে (পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয়ের পর) তার এই ধরনের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিলো।

রাজনৈতিক সংযোগ: তার কিছু শিষ্য, যেমন অ্যালসিবিয়াডিস এবং ক্রিটিয়াস, পরবর্তীকালে এথেন্সের গণতন্ত্র-বিরোধী ‘থার্টি টাইর‍্যান্টস’ (Thirty Tyrants) নামে পরিচিত অত্যাচারী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও সক্রেটিস সেই গোষ্ঠীর কাজের বিরোধিতা করেছিলেন, তবুও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছিল।

মূল্যবোধের প্রতি প্রশ্ন: সক্রেটিস এথেনীয়দের তাদের অর্থ, ক্ষমতা ও সুনামের প্রতি অত্যধিক মনোযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তিনি যুক্তি দিতেন যে আত্মিক উন্নতি, সত্য ও জ্ঞানের অনুসন্ধানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের প্রশ্ন তৎকালীন এথেনীয় সমাজের মূল চালিকাশক্তির বিরুদ্ধে গিয়েছিলো বারংবার।

অতএব, সক্রেটিসের মৃত্যু কোনো একক প্রশ্ন তোলার জন্য হয়নি, বরং তাঁর প্রশ্ন তোলার দর্শন। সত্য, জ্ঞান এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা ও প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত্তি চ্যালেঞ্জ করার পরিণাম তাকে ভোগ করতে হয়েছে। তবে এই প্রশ্নই তাঁকে আজও কালজয়ী করে রেখেছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ছিল মূলত এই চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষোভের আইনি আবরণ।

Corosity Inner 5

কৌতূহলের রাজনীতি
ইতিহাস বলে, যতোবার কোনো সমাজ প্রশ্নের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, ততোবারই থেমে গেছে তার অগ্রগতি।
মধ্যযুগে চার্চ যখন বলেছিলো- “পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র”- গ্যালিলিওর কৌতূহল সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিল।
আর আজ, যেসব রাষ্ট্রে “প্রশ্ন” মানে “অপরাধ”, সেই রাষ্ট্রগুলো অগ্রগতির দৌড়ে পিছিয়ে আছে সবচেয়ে বেশি।
কৌতূহল তাই কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। একটি সমাজ যতো বেশি প্রশ্ন সহ্য করতে শেখে, ততো বেশি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়।

আগামী প্রজন্মের সামনে চ্যালেঞ্জ: তথ্য নয়, অনুসন্ধান
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হাতের মুঠোয়। তবু মানুষ আগের চেয়ে কম কৌতূহলী।
কারণ, উত্তর পাওয়া সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু প্রশ্ন তৈরির সাহসটা হারিয়ে যাচ্ছে। আজ সার্চ ইঞ্জিন জানে “তুমি কী খুঁজছো”,
কিন্তু জানে না “তুমি কী জানতে চাও।” এটাই আধুনিক কৌতূহলের সংকট। যেখানে প্রযুক্তি প্রশ্নের বিকল্প দিচ্ছে, কিন্তু উত্তর নয়। ব্যবসায়িক স্বার্থে লুপে আটকে দেয়া হচ্ছে বারবার।

প্রযুক্তির যুগে কৌতূহল: মেশিনও কি জানতে চায়?
একসময় কৌতূহল ছিল কেবল মানুষের বৈশিষ্ট্য। আজ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- এক নতুন “যান্ত্রিক কৌতূহল”। MIT Media Lab-এ কৃত্রিম কৌতূহল (Artificial Curiosity) নিয়ে একাধিক গবেষণা চলছে। সেখানে দেখা গেছে, মেশিন যদি কৌতূহলপ্রবণ হয়- অর্থাৎ নিজে থেকে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে-
তাহলে সে শুধু তথ্য শেখে না, নতুন সমাধানও খুঁজে পায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, DeepMind-এর “Curiosity-driven learning” মডেল, যেখানে এ আই শেখে পুরস্কারের জন্য নয়, শেখার আনন্দের জন্য।

এ যেন সক্রেটিসের প্রোগ্রাম করা সংস্করণ!
কী? কোথাও অসংগতি লাগছে? না, প্রশ্ন করার যে ব্যাপারটা এটা মানুষই এআই কে সেট করে দিচ্ছে এবং এখনও পর্যন্ত মেশিনের মধ্যে কৌতূহলের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কৌতূহল মানুষেরই আর এ আই মাত্রই কৌতূহল মেটানোর একটা টুল মাত্র। তবে এই AI নিয়ে বর্তমান সময়ের মানুষের কৌতূহলের যেন শেষ নেই।
তবে এখানেই এক বিপদও আছে। মানুষের কৌতূহল মানে অজানার প্রতি দায়িত্বও, কিন্তু মেশিনের ক্ষেত্রে নেই সেই নৈতিকতা। তাই প্রশ্ন উঠছে- যদি কোনোদিন মেশিন “কৌতূহলীভাবে” সিদ্ধান্ত নেয়, আর তাতে ক্ষতি হয়, তবে দায় কার?
এই প্রশ্নটিও আবার মানুষকেই করতে হচ্ছে-নিজের তৈরি কৌতূহলের উত্তর খুঁজতে।

Corosity Inner 4

প্রশ্নের সাহসই মানবসভ্যতার প্রাণ
সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল প্রশ্নের জন্য। আর আজ, সার্চ ইঞ্জিনের অস্তিত্বও প্রশ্নের জন্যই। হাজার বছর পার হয়ে গেছে-
কিন্তু মানুষের অগ্রগতি এখনও একটাই সূত্রে বাঁধা:
যে প্রশ্ন করে, সেই এগোয়।
কৌতূহলই মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে প্রকৃতির অন্য প্রাণীদের থেকে এবং হয়তো একদিন, এই কৌতূহলই মেশিনের ভেতর নতুন মানবিকতা জাগাবে। হয়তো জাগাবে না। তবুও প্রশ্ন থামলেই থেমে যাবে মানুষ, থেমে যাবে সভ্যতার উন্নতি।

তথ্যসূত্র:
• Ian Leslie, Curious: The Desire to Know and Why Your Future Depends on It
• Stanford Encyclopedia of Philosophy – “Curiosity”
• MIT Media Lab – “Artificial Curiosity and Intrinsic Motivation Models”
• Culture Kids and Thomas Oppong