
১০ প্রাচীন সভ্যতা, যারা গড়েছে আজকের পৃথিবী
ইতিহাস সাধারণত সেইসব মানুষের কথাই মনে রাখে, যারা সবচেয়ে জোরে কথা বলেছে—যুদ্ধজয়ী রাজা, সেনাপতি বা শাসক, যাদের নাম পাঠ্যবইয়ে লেখা আছে, যাদের মূর্তি এখনো পর্যটকদের টানে।
কিন্তু সিজার বা আলেকজান্ডারের মতো প্রতিটি বড় নামের আড়ালে আছে অনেক নীরব সভ্যতা—যারা পৃথিবীকে গড়ে তুলেছিল নিঃশব্দে, ছায়ার মতো। তাদের অবদান লুকিয়ে আছে আমাদের ভাষায়, আইনে, উৎসবে, এমনকি সেই স্থাপত্যে, যা আমরা প্রতিদিন দেখি অথচ খেয়াল করি না।
এই সভ্যতাগুলো রোমের মতো সাম্রাজ্য বানাতে পারেনি, কিন্তু তাদের চিন্তা ও উদ্ভাবন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ পাহাড় খুঁড়ে বানিয়েছে সোনা, কেউ মরুভূমিতে শিখেছে পানি আনার কৌশল।
তাদের স্পর্শ আজও রয়ে গেছে—যদি আপনি মন দিয়ে খুঁজে দেখতে চান।
এখানে আছে এমন দশটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী, যাদের নাম হয়তো আমরা ভুলে গেছি, কিন্তু যাদের প্রভাব আজও টিকে আছে আমাদের চিন্তা, সংস্কৃতি ও জীবনে। চলুন ইতিহাসের অন্ধকার প্রান্তে যাই—যেখানে অবহেলিতরাই গড়ে দিয়েছে সভ্যতার ভিত।

এত্রুস্কান ।। ছবি: সংগৃহীত
এত্রুস্কান— রোমের নীরব স্থপতি
ইতালির ইতিহাস বললেই আমরা রোমের কথা ভাবি। কিন্তু রোমের আগেই ছিল এক রহস্যময় জাতি—এত্রুস্কানরা।
খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ৩০০ সালের মধ্যে মধ্য ইতালিতে তারা ছিল রোমানদের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক।
রোম শহর পরিকল্পনা, স্থাপত্য আর ধর্মীয় রীতিতে যা শিখেছিল—তার অনেকটাই এসেছে এত্রুস্কানদের কাছ থেকে। সড়ক, নিকাশি ব্যবস্থা, এমনকি বিজয়ের প্রতীক “ত্রায়ামফাল আর্চ” ধারণাটিও তাদের। রোমানদের বিখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর খেলাটিও নাকি এসেছে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতির প্রভাব থেকে।
রাজনীতি ও প্রতীকের ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব ছিল গভীর। “ফ্যাসেস”—একটি কুঠার ঘেরা দণ্ডের প্রতীক—এত্রুস্কানদেরই সৃষ্টি, যা পরে রোমান ক্ষমতার প্রতীক হয়। আজও রোমের মন্দির ও দেয়ালচিত্রে তাদের শিল্প, ভাষা ও ধর্মীয় প্রভাব দেখা যায়।
রোম হয়তো ইতিহাসের আলোয় এসেছে, কিন্তু তার ভিত্তি গেঁথেছিল এই নীরব স্থপতিরাই।

সগডিয়ান ।। ছবি: সংগৃহীত
সগডিয়ান— বিশ্বকে সংযুক্ত করা ভুলে যাওয়া বণিক
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ধারণা আজ যতটা স্বাভাবিক, সেই ভাবনার শুরু হয়েছিল সগডিয়ানদের হাতেই।
খ্রিস্টীয় ৪র্থ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে মধ্য এশিয়ার এই বণিক জাতি সিল্ক রোডকে বানিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য পথ।
তারা যুদ্ধ নয়, বরং চুক্তি আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জয় করেছিল পৃথিবীকে। তাদের কাফেলায় থাকত রেশম, মশলা, কাঁচ, আর গল্প—যা এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যেত নতুন সংস্কৃতি।
সামরকন্দ ও বুখারার মতো শহরগুলো ছিল প্রকৃত “গ্লোবাল সিটি”—যেখানে মিশে যেত পারস্য, ভারত, চীন ও আরব সংস্কৃতি।
তাদের মাধ্যমেই বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে চীন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর পরবর্তীতে ইসলামও সেই পথেই ছড়িয়ে পড়ে।
শেষে তারা বড় সাম্রাজ্যের ভেতর মিশে যায়, কিন্তু তাদের সংস্কৃতি আজকের “গ্লোবালাইজেশন”-এর প্রথম অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। বিশ্বের যেভাবে সংস্কৃতি ও বাণিজ্য মিলেমিশে গেছে, তার সূচনা হয়েছিল সেই সগডিয়ান কাফেলার ঘণ্টাধ্বনিতে।

মিনোয়ান ।। ছবি: সংগৃহীত
মিনোয়ান— ইউরোপের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা
গ্রিসের দেবতা ও গণিতের গল্পের আগেই ছিল এক দ্বীপ—ক্রিট। সেখানেই খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে মিনোয়ান সভ্যতা—ইউরোপের প্রথম উন্নত সভ্যতা।
তাদের রাজধানী কনোসোস ছিল সত্যিকারের রাজপ্রাসাদের শহর—বহুতল ভবন, পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা, দেয়ালচিত্র, বিশাল গুদামঘর। এই গোলকধাঁধার মতো স্থাপত্যই হয়তো “মিনোটর”-এর গল্পের উৎস।
তারা যুদ্ধ নয়, বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেছিল। জলপাই তেল, মদ, ও মৃৎশিল্প তারা ছড়িয়ে দিয়েছিল ভূমধ্যসাগরে। তাদের নৌচালনা, শিল্পরীতি ও পুরাণ—সবই পরে গ্রিক সংস্কৃতির ভিত হয়ে ওঠে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ সালে থেরা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে তাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়, তবুও তাদের সৃষ্টিশীলতা ইউরোপের সাংস্কৃতিক ভোরের আলো হয়ে আছে।

ওলমেক ।। ছবি: সংগৃহীত
ওলমেক — আমেরিকার সভ্যতার সূচনা
মায়া ও অ্যাজটেকদের আগেই, মেক্সিকোর উপসাগরীয় উপকূলে বাস করত ওলমেকরা। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৪০০ সালের মধ্যে তারা গড়ে তোলে মেসোআমেরিকার প্রথম সংগঠিত সভ্যতা।
তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন হলো বিশাল পাথরের মাথা—যা আজও প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাবায়। ওলমেকরাই প্রথম ক্যালেন্ডার, লিখনব্যবস্থা এবং বলখেলার প্রচলন ঘটায়, যা পরবর্তীতে মায়া ও অ্যাজটেক সংস্কৃতির অংশ হয়।
তারা হারিয়ে গেলেও তাদের সংস্কৃতি এখনো টিকে আছে প্রতিটি পিরামিড ও প্রতীকে।

স্কিথিয়ান ।। ছবি: সংগৃহীত
স্কিথিয়ান — ট্যাটু পরা অশ্বারোহী যোদ্ধা
চেঙ্গিস খানের বহু আগে ইউরেশিয়ার তৃণভূমিতে রাজত্ব করেছিল স্কিথিয়ানরা (খ্রিস্টপূর্ব ৯০০–২০০)। তারা ছিল ভ্রাম্যমাণ যোদ্ধা, যাদের শক্তি ছিল ধনুক, ঘোড়া ও সাহসে।
ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস তাদের ভয়ংকর বলে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস জানায়—তারা ছিল শিল্পপ্রেমী ও রুচিশীল। তাদের সোনার অলঙ্কার, অস্ত্র ও ট্যাটু আজও বিস্ময় জাগায়। ঘোড়ায় চড়া আর টাইট প্যান্ট পরার ফ্যাশনও এসেছে তাদের কাছ থেকে।
তারা বিলীন হয়ে গেলেও তাদের মুক্ত, বন্য আত্মা এখনো ইতিহাসের প্রতিটি যোদ্ধার কাহিনিতে ছুটে চলে।

হিটাহট ।। ছবি: সংগৃহীত
হিটাইট— শান্তিরক্ষাকারী প্রথম কূটনীতিক
যখন অন্য সভ্যতারা যুদ্ধ শিখছিল, হিটাইটরা শিখেছিল শান্তির কৌশল। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের দিকে আজকের তুরস্কে গড়ে ওঠে তাদের রাজ্য, যা একসময় মিশর ও ব্যাবিলনের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
তারা লৌহকর্মে পারদর্শী ছিল, কিন্তু আসল বিপ্লব ঘটায় কূটনীতিতে।
ফারাও রামেসিস দ্বিতীয়-এর সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর তারা স্বাক্ষর করে “কাদেশ চুক্তি”—যা মানব ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক শান্তিচুক্তি। এতে ছিল পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা—যেন প্রাচীন যুগের ন্যাটো!
তারা আইনসংহিতা তৈরি করে, ধর্মীয় বিনিময় ঘটায়, এবং প্রমাণ করে—কখনো কখনো কলম তলোয়ারের চেয়েও শক্তিশালী।

নাবাতিয়ানদের গড়ে তোলা পেত্রা ।। ছবি: সংগৃহীত
নাবাতিয়ান — মরুভূমির প্রকৌশলী
যেখানে এক ফোঁটা পানি সোনার চেয়েও দামী, সেখানে নাবাতিয়ানরা গড়ে তুলেছিল এক বিস্ময়—পেত্রা। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১০৬ সাল পর্যন্ত তারা আজকের জর্ডান, সিরিয়া ও সৌদি আরবের মরুভূমিতে স্থাপন করে রাজ্য।
তারা পানির প্রতিটি ফোঁটা কাজে লাগাতে শিখেছিল। খাল, পাইপলাইন ও জলাধার বানিয়ে তারা মরুভূমিকেও উর্বর করে তুলেছিল। মশলা ও ধূপের ব্যবসায় তাদের প্রভাব ছিল বিরাট।
যদিও পরে তারা রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায়, তাদের স্থাপত্যশৈলী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
পেত্রা আজও প্রমাণ করে—মানুষ চাইলে মরুভূমিকেও শিল্পে রূপ দিতে পারে।

জোমনদের প্রতিকৃতি ।। ছবি: সংগৃহীত
জোমন— জাপানের প্রাচীন শিল্পী
জাপানে সম্রাট বা সামুরাই আসার বহু আগে, প্রায় ১৪,০০০–৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাস করত জোমন জাতি। তারা ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক, কিন্তু সংস্কৃতিতে ছিল আশ্চর্য উন্নত।
তাদের তৈরি দড়ির ছাপযুক্ত হাঁড়িপাতিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎশিল্পগুলোর একটি। তারা বসতি গড়েছিল, খাদ্য সংরক্ষণ জানত, আর বানাত দোগু নামের ছোট মাটির মূর্তি, যা সম্ভবত ধর্মীয় প্রতীক ছিল।
লিখনব্যবস্থা না থাকলেও তাদের প্রকৃতি-নির্ভর জীবনদর্শন আজও জাপানের শিন্তো ধর্মের অনুপ্রেরণা। জোমনরা দেখিয়েছিল—সভ্যতা শুরু হয় সৃজনশীলতা থেকে, রাজা বা প্রাসাদ থেকে নয়।

ফিনিশীয়রাই উদ্ভাবন করেছিল বেগুনি রঙ ।। ছবি: সংগৃহীত
ফিনিশীয়— মানুষকে লিখতে শিখিয়েছিল
প্রাচীন বিশ্বের সেরা সমুদ্রযাত্রী ও ব্যবসায়ী ছিল ফিনিশীয়রা। বর্তমান লেবানন উপকূল থেকে তারা কাঠ, কাঁচ ও বেগুনি রঙের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় অবদান—বর্ণমালা।
তারা লিখনব্যবস্থাকে সরল করে তোলে—হাজারো চিহ্নের বদলে মাত্র ২২টি ধ্বনিভিত্তিক অক্ষর ব্যবহার শুরু করে।
এই পদ্ধতিই পরে গ্রিক ও ল্যাটিন অক্ষরমালার ভিত্তি হয়।
তারা ভূমধ্যসাগরজুড়ে উপনিবেশ গড়ে—সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল কার্থেজ, যা রোমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। অবাক করা বিষয় হলো—যারা মানুষকে লিখতে শিখিয়েছে, ইতিহাস তারাই সবচেয়ে কম লিখে রেখেছে।

আইনু জাতি ।। ছবি: সংগৃহীত
আইনু — জাপানের বিস্মৃত আদিবাসী
সামুরাইদের যুগের বহু আগে জাপানের উত্তরে বাস করত এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী—আইনু। তাদের চেহারা ছিল ভিন্ন, ভাষাও আলাদা। তারা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল—নদী থেকে স্যামন মাছ ধরত, ভালুক শিকার করত, আর বিশ্বাস করত প্রতিটি জিনিসে এক দেবতা-স্বরূপ আত্মা (কামুই) আছে।
জাপানি সাম্রাজ্য উত্তর দিকে বিস্তৃত হলে তারা ভূমি ও স্বাধীনতা হারায়। ১৮০০ সালের পর তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিষিদ্ধ হয়। তবুও তারা টিকে থাকে—২০১৯ সালে জাপান সরকার তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আজ আইনু সংস্কৃতি নতুন করে জেগে উঠছে—ভাষা শেখানো হচ্ছে, শিল্প ও ঐতিহ্য ফিরছে। তাদের গল্প শুধু বেঁচে থাকার নয়, বরং আত্মপরিচয়ের জন্য এক অদম্য সংগ্রামের গল্প।
আইনু জাতি প্রমাণ করেছে—ইতিহাস তোমাকে মুছে ফেলতে পারে, কিন্তু তুমি নিজেই আবার ইতিহাস হয়ে ফিরে আসতে পারো।




























