
জানি না সেই অসংখ্য “নামহীন” মস্তিষ্কের কথা, যারা এমন বহু সাফল্যের ভিত্তি রচনা করে দিয়ে গেছেন
মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রা সবসময়ই উদ্ভাবনের কাঁধে ভর করে এগিয়েছে। আগুন জ্বালানো থেকে ইন্টারনেট আবিষ্কার- প্রতিটি পদক্ষেপই এসেছে কারও কৌতূহল, ভুল, পরীক্ষা, কিংবা রাতজাগা শ্রমের ফসল হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমরা কি জানি সেই মানুষগুলোর নাম? না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না। আমরা জানি এডিসন, নিউটন বা স্টিভ জবসের নাম, কিন্তু জানি না সেই অসংখ্য “নামহীন” মস্তিষ্কের কথা, যারা এমন বহু সাফল্যের ভিত্তি রচনা করে দিয়ে গেছেন।

যারা আবিষ্কার করেও ইতিহাসে হারিয়ে গেছেন
Smithsonian Archives এবং New York Times–এর “Overlooked” সিরিজে এমন বহু উদ্ভাবকের নাম পাওয়া যায়, যারা তাঁদের যুগে বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু স্বীকৃতি পাননি। যেমন, Mary Beatrice Davidson Kenner- যিনি sanitary belt (প্যাডের প্রাথমিক রূপ) তৈরি করেছিলেন, কিন্তু বর্ণবৈষম্যের কারনে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে তার পেটেন্ট গ্রহণ করেনি কোনো কোম্পানি।
আবার Garrett Morgan, একজন কৃষ্ণাঙ্গ উদ্ভাবক, যিনি গ্যাস মাস্ক এবং ট্রাফিক সিগন্যালের প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি করেছিলেন- তাঁর নাম ইতিহাস বইয়ে খুব কমই আসে।
National Geographic History ম্যাগাজিন বলছে, “For every celebrated inventor, there are dozens who built the foundation quietly.” – প্রতিটি বিখ্যাত উদ্ভাবনের পেছনে আছে এমন বহু নিঃশব্দ প্রতিভা।
আবার রেডিও কে আবিষ্কার করেছিলো এমন প্রশ্ন সামনে আসতেই সবার চোখে ভেসে ওঠে মারকনীর কথা, কিন্তু এর ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন এই বাংলার জগদীশ চন্দ্র বসু।

নারী উদ্ভাবকরা, যাঁদের নাম চাপা পরে গেছে পেটেন্টের কাগজে
লিঙ্গবৈষম্য ও উদ্ভাবনের রাজনীতি
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস মূলত পুরুষকেন্দ্রিক বর্ণনায় ভরা। Rosalind Franklin–এর কথা মনে করুন- DNA-এর গঠন আবিষ্কারে তাঁর অবদান ছাড়া Watson ও Crick-এর সাফল্য কল্পনাই করা যেতো না। অথচ জীবিত অবস্থায় উপেক্ষিত হয়েছিলেন তিনি।
এমনকি গৃহস্থালির জিনিস- washing machine, ironing board, বা paper bag- এসবের পেছনেও ছিলেন নারী উদ্ভাবকরা, যাঁদের নাম চাপা পরে গেছে পেটেন্টের কাগজে পুরুষ সহযোগীদের নামের নিচে।

চীনের কাগজ তৈরি, ভারতের স্টিল উৎপাদন, বা আরবদের অপটিক্যাল প্রযুক্তি- সবই এক সময় “পশ্চিমা আবিষ্কার” হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল
যখন জ্ঞান হয় দখলদারি
ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু উদ্ভাবনকে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন, দুষ্টু বুদ্ধির চক্রধাঁধায় পেটেন্ট করিয়ে নিয়েছিলেন।
চীনের কাগজ তৈরি, ভারতের স্টিল উৎপাদন, বা আরবদের অপটিক্যাল প্রযুক্তি- সবই এক সময় “পশ্চিমা আবিষ্কার” হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল। Smithsonian-এর নথিতে দেখা যায়, এই জ্ঞানের অনেকটাই সংগ্রহ করা হয়েছিল “anthropological curiosity” বা “civilizing mission”-এর নামে।
জ্ঞানের ইতিহাস আসলে এক অদৃশ্য যুদ্ধের ইতিহাস- যেখানে প্রশ্নটা কেবল “কে আবিষ্কার করলো?” নয়, বরং “কারা সে আবিষ্কারের স্বীকৃতি পেলো?”
উদ্ভাবন মানেই কেবল নতুন কিছু সৃষ্টি নয়- কখনো কখনো এটি ক্ষমতার হাতিয়ারও। ইতিহাসে অসংখ্য উদ্ভাবন আছে, যার স্বীকৃতি তথা “মালিকানার অধিকারী স্বত্বা” গেছে অন্য কারও হাতে, আর আসল উদ্ভাবকরা থেকে গেছেন নামহীন, নিঃশব্দ, নিঃস্বীকৃত।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ভারতের আয়ুর্বেদ ও যোগচর্চা, যা হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল একটি জ্ঞানের বিজ্ঞান। কিন্তু উপনিবেশিক যুগে পশ্চিমা গবেষকরা সেই জ্ঞানকে নিজেদের ভাষায় পুনর্লিখন করে “নিজের আবিষ্কার” হিসেবে পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে হাজির করেন। পরিণতিতে, জ্ঞানের জন্মভূমি হয়ে গেলো নিঃশব্দ পর্যবেক্ষক, আর মালিকানা চলে গেলো ঔপনিবেশিক হাতে।

উদ্ভাবন মানেই কেবল নতুন কিছু সৃষ্টি নয়- কখনো কখনো এটি ক্ষমতার হাতিয়ারও
একই ঘটনা দেখা যায় টেক্সটাইল বা বস্ত্রশিল্পে। অষ্টাদশ শতকের আগে ভারতীয় মসলিন, সুতিবস্ত্র ও রঙ করার প্রযুক্তি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই কারিগরি জ্ঞান সরাসরি ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে কারখানা স্থাপন করে, এবং সেই পণ্যের বৈশ্বিক বাজার দখল করে নেয়। অথচ, মসলিন তৈরি করতেন যে বাঙালি তাঁতিরা- তাদের নাম, তাদের উদ্ভাবনী কৌশল- সব হারিয়ে যায় ইতিহাসের অন্ধকারে।
আফ্রিকান উদ্ভাবকদের গল্পও তাই। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিজ্ঞানের পথিকৃৎ জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার বহু কৃষিপণ্য উদ্ভাবন করলেও, তাঁর আগে আফ্রিকার কৃষকদের তৈরি পদ্ধতি ও বীজ সংরক্ষণ সংস্কৃতিই তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল- কিন্তু এই ঐতিহ্য কখনো “আফ্রিকান ইনোভেশন” নামে ইতিহাসে জায়গা পায়নি।
আরেকটি আধুনিক উদাহরণ হলো “ঔপনিবেশিক অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন” -যেখানে আদিবাসী বা স্থানীয় সমাজের জ্ঞানকে বড় কর্পোরেশন বা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে, তারপর সেটার পেটেন্ট নিজেদের নামে নেয়। যেমন, নিম গাছ, হলুদ, বা বাসমতী চালের জিনগত পেটেন্ট নিয়ে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বিরোধ এ নিয়ে পুরো এক যুগ ধরে চলে।
MIT Media Lab বা Stanford d.school-এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণেও এই বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে- “who owns curiosity, owns innovation।”
অর্থাৎ, জ্ঞান কেবল সৃষ্টি নয়; এটা ক্ষমতার এক ধরনের নিয়ন্ত্রণও বটে।
এ কারণেই আধুনিক কালে “ওপেন সোর্স ইনোভেশন” বা “collective invention” আন্দোলনগুলো জোর পাচ্ছে- যাতে জ্ঞানের মালিকানা কেবল গুটিকয়েক কর্পোরেশন বা রাষ্ট্রের হাতে না থেকে, সবার কাছে উন্মুক্ত থাকে।
দলগত প্রতিভার নীরব বিপ্লব
সব উদ্ভাবকই যে একজন একক নায়ক- এ ধারণাটাই ভুল। শিল্পবিপ্লবের সময়কার “collective invention” ধারণা বলে, বহু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এসেছে একদল মেকানিক, কারিগর, ও ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক সহযোগিতায়।
কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় এই সম্মিলিত অবদানগুলো হারিয়ে গেছে “hero inventor” দের গল্প বলার আদিখ্যেতায়- যেখানে একক নামকেই দেবতা বানানো হয়।
নামহীনতার মাঝেও ইতিহাস বেঁচে থাকে
উদ্ভাবনের ইতিহাস মূলত মানবজিজ্ঞাসার ইতিহাস- যেখানে নাম যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, কাজ ততোটাই অনন্য। হয়তো সেই নামহীন উদ্ভাবকরাই আজ আমাদের হাতের মোবাইল, টেবিলের লাইট, বা দরজার হ্যান্ডেল তৈরি করার প্রেরণা হয়ে আছেন।
ইতিহাস সাধারণত সেইসব মানুষের নামই মনে রাখে, যাদের আবিষ্কার আলো ছড়িয়েছে—এডিসন, বেল, নিউটন কিংবা আইনস্টাইনদের মতো। কিন্তু সভ্যতার প্রকৃত অগ্রগতি টিকে আছে তাঁদের হাত ধরে, যাদের নাম আমরা জানি না।
প্রযুক্তি ইতিহাসবিদ রুথ শোয়ার্জ কাউয়ান (Ruth Schwartz Cowan) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ More Work for Mother (১৯৮৩)-এ দেখিয়েছেন- “Technological change is as much a social process as a mechanical one.” অর্থাৎ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন কেবল যান্ত্রিক বিষয় নয়; এটি এক সামাজিক প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে “বড় আবিষ্কার” সাধারণত কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে স্বীকৃতি পায়, কিন্তু বাস্তবে প্রযুক্তিগত বিপ্লব আসে “অগণিত ছোট ছোট, নামহীন উদ্ভাবনের প্রসারে”। এগুলোই নিঃশব্দে বদলে দেয় মানুষের জীবন, কাজের ধরন, আর সামাজিক অবকাঠামো।
রুথ কাউয়ানের বিশ্লেষণ অনুসারে, প্রকৃত উদ্ভাবনের গল্পটা একক নয়- এটা “collective invention”, যেখানে মেশিন তৈরির কারিগর, গৃহিণী, কারখানার কর্মী, কিংবা অখ্যাত কোনো যন্ত্রবিদ- সবাই মিলে সভ্যতার চাকা ঘোরায়।
এই নামহীন মানুষগুলোর কাজ হয়তো কোনো পাঠ্যপুস্তকে নেই, কিন্তু তাঁদের তৈরি ছোট ছোট প্রযুক্তিগত পরিবর্তনই আধুনিক সভ্যতার ভিতকে শক্ত করেছে। যেমন, ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহারিক রূপ তৈরিতে হাজারো নারীর ঘরোয়া অভিজ্ঞতা কাজ করেছে, অথচ তাদের নাম আমরা জানি না।
এই নামহীন প্রতিভারাই আসলে মানবতার প্রকৃত নায়ক।





























