শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
রিয়াজুল হক মতামত ২৮ জুলাই ২০২৫, ৪:৩৩ অপরাহ্ন
শেয়ার

বৃষ্টির দিনে মৃত্যু ফাঁদ খোলা ম্যানহোল!


বৃষ্টির দিনে মৃত্যু ফাঁদ খোলা ম্যানহোল

বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা, যানজট আর নাগরিক দুর্ভোগ। তবে এসবের চেয়েও ভয়ংকর এক বিপদ থাকে চোখের আড়ালে—খোলা ম্যানহোল। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। নিচে কী আছে, সেটা বোঝার উপায় থাকে না। তখন যদি ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকে, সেটা মুহূর্তেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং হারাচ্ছেন।

২০২৩ সালের আগস্টে ঢাকার মগবাজার এলাকায় ভারী বৃষ্টির মধ্যে এক শিশু খোলা ম্যানহোলে পড়ে যায়। আশেপাশের মানুষ দেখেছে, সবাই চিৎকার করে করেছে , কিন্তু কেউই বাঁচাতে পারেনি। উদ্ধারকর্মীরা পরে তার নিথর দেহ উদ্ধার করে। এমন ঘটনা নতুন নয়।

প্রতিবছর বর্ষার সময় একাধিক সংবাদ চোখে পড়ে। কোনো ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পা পড়ল খোলা ম্যানহোলে, তারপর তলিয়ে গেলেন। কেউ উদ্ধার পান, কেউ ফিরে আসেন না। কখনো স্কুলগামী শিশু, কখনো গার্মেন্টস কর্মী, আবার কখনো সাধারণ পথচারী, এই মৃত্যু কোনও শ্রেণির মানুষকে চেনে না। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহীতেও এমন ঘটনা ঘটে। কোনো দুর্ঘটনার পর কিছুদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলে, এরপর আবার সব আগের মতো হয়ে যায়। অথচ এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য। শুধু দরকার সচেতনতা, দায়িত্ববোধ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা।

অনেক সময় দেখা যায়, ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে গেছে, কেউ সেটা রিপোর্ট করেনি। আবার যারা চুরি হতে দেখেছেন, তারাও চুপ থাকেন। চোরেরা লোহার ঢাকনাগুলো কেটে কেজি দরে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর এই খোলা ঢাকনার ভেতরই ঢুকে যেতে পারে একজন মানুষের জীবন।

সাধারণত বৃষ্টির সময় এই বিপদ গুরুতর হয়ে ওঠে। বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায়। তখন খোলা ম্যানহোল চোখেই পড়ে না। মানুষ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই পড়ে যায় সেই অদৃশ্য গর্তে। যারা পাশে থাকে, তারাও টের পাননা, ঠিক কোথায় দুর্ঘটনা ঘটল। তখন উদ্ধার কাজেও বিলম্বিত হয়। প্রাণ হারানোর ঝুঁকি বাড়ে। তবে এই ঝুঁকি হ্রাস কিংবা কমানোর জন্য কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

১. উন্নত দেশগুলোতে ঢাকনার সঙ্গে সেন্সর লাগানো থাকে, যেটা খুললে অ্যালার্ম বাজে। এমনকি জিপিএস-সেন্সর যুক্ত ম্যানহোল ব্যবস্থাও এখন বাস্তবতা।
২. ঢাকনায় লোহা না রেখে ফাইবার গ্লাস বা পলিমার কম্পোজিট ব্যবহার করলে চুরি ঠেকানো সম্ভব।
৩. যেকোনো ম্যানহোল খোলা পাওয়া গেলে নাগরিকেরা যেন সরাসরি ফোন বা অ্যাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন, এমন হটলাইন বা অ্যাপ চালু করা যেতে পারে।
৪. কোন এলাকায় কতগুলো ম্যানহোল আছে, তার ডিজিটাল মানচিত্র থাকা প্রয়োজন এবং সেটি প্রতিমাসে হালনাগাদ করা উচিত।
৫. সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে গঠিত টিম নিয়মিত রাস্তাঘাট পর্যবেক্ষণ করবে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।
৬. জনগণ চাইলে অবশ্যই পরিবর্তন সম্ভব। এক্ষেত্রে নাগরিক পর্যবেক্ষণ দল গঠন করে এলাকা ভিত্তিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো যেতে পারে।

একটি ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকলে, তাতে কত বড় বিপদ হতে পারে, সেটা হয়তো আমরা কল্পনাও করি না। কিন্তু যার পরিবার তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারায় কিংবা প্রিয়জনকে হারায়, তাদের জীবনে সেই একটি ঢাকনা মানে, সবকিছু হারিয়ে ফেলা। আমরা যদি বৃষ্টির আগে আমাদের এলাকার ম্যানহোলগুলো চোখে দেখি, যদি কিছু না পারি অন্তত একটা বাঁশ বা ফিতার সাহায্যে চিহ্নিত করে দিই, তবেও হয়তো একটি দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব।এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। নাগরিক, পথচারী, দোকানদার, রিকশাচালক সবার। কারণ এই শহর আমাদের।

রিয়াজুল হক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।