শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক লাইফস্টাইল ১ অক্টোবর ২০১৩, ৯:১৩ অপরাহ্ন
শেয়ার

দুর্গাপূজার সামাজিক তাৎপর্য


১ অক্টোবর ২০১৩, সিউল:

আসছে দুর্গাপূজা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশের মত কোরিয়ায়ও দুর্গাপূজা পালিত হবে। প্রতিবছরের মত এবারও উইজংবু’র রাধা গোবিন্দ মন্দিরে দুর্গাপূজা পালিত হবে। দুর্গাপূজা নিয়ে লিখেছেন সঙ্গীতশিল্পী ও তথ্যচিত্র নির্মাতা আশুতোষ অধিকারী।

আজ আমি পৌরাণিক ভাবে নয়, সাধারন দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গাপূজার সামাজিক তাৎপর্য আলোচনা করবো। দুর্গাপূজা নিয়ে অনেকের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান হয়তো পেয়েও যেতে পারেন। এই লেখাটি পড়ে যদি কারও ভাল লাগে তাহলেই লেখাটি সার্থকতা লাভ করবে বলে মনে করছি। প্রথমে আসি প্রতিমার কথায়-

প্রতিমা পূজা কি?
মহাশক্তির কল্পিত রূপকে প্রতিমার মাধ্যমে প্রকাশ করে মনোযোগ স্থাপন করতেই প্রতিমাপূজা। মায়ের ফটোগ্রাফ দেখলে যেমন মায়ের কথা মনে হয় তেমনি প্রতিমার মাঝে দৃষ্টি রাখলে মন ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারে। শক্তি পুরুষও নয় মহিলাও নয়। কিন্তু মনের ধ্যান-যোগের জন্য প্রতীক ব্যবহার। তাই প্রতিমা।
কবির ভাষায়- “মূর্তি পুজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া
মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে হয়ে যায় আত্মহারা”

প্রতিমা বর্ণনাঃ
দুর্গাঃ প্রকৃতির যে মহাশক্তি মানুষের দুর্গতি দূর করে বা নাশ করে তাই দুর্গা। ‘শক্তি’ শব্দটা ব্যাকরণগত ভাবে স্ত্রীলিঙ্গ, তাই দুর্গা মাতৃরূপা। তার দশ হাত কেন? হ্যাঁ, মুনিঋষিগণ যখন দুর্গা কল্পণা করেছেন সে সময় ‘দশ’ বলতে সমাজ বোঝাতো। তাই দশেমিলে দশদিক থেকে দশহাতে অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতেই দুর্গাপূজার আয়োজন। এটি আসলে প্রকৃতির পূজা। তার ত্রিনেত্র। কারন সে যে ত্রিকাল দর্শী। তিনি অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা।

সরস্বতীঃ জ্ঞান-এর মূর্তি। বই হল জ্ঞান আর বীণা হল সঙ্গীতকলার প্রতীক । কিন্তু এটি এখানে ব্রাহ্মণ বর্ণকে বোঝানো হয়েছে। যারা বিদ্বান, পণ্ডিত, সঙ্গীতজ্ঞ- তারা সমাজে ব্রাহ্মণ। তারা সমাজকে শিক্ষা দেয়। সমাজের উপদেষ্টা।

কার্তিকঃ ক্ষত্রিয় বর্ণ। সমাজ কে রক্ষা করার দায়িত্ব যার। বলা যায় রাজা বা শাসক। তীর-ধনুক হল শাসক-এর প্রতীক। যারা ঘুরে ঘুরে রাজ্য বা সমাজ পরিচালনা করবে। তারা ক্ষত্রিয়, সমাজের পরিচালক, সেনাপতি।

লক্ষ্মীঃ ধনদেবী। ধন আহরণের জন্য এবং সে ধনকে সংরক্ষন করতেই এই শক্তির পূজা। সমাজে এটি বৈশ্য বর্ণের প্রতীক। গৃহস্থ এবং ব্যবসায়ী সবাই এই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত।

গণেশঃ গণের দেবতা। মানে শ্রমের দেবতা বা গনশক্তি। সমাজে এটি শূদ্রের প্রতীক। পৃথিবীতে সকল শ্রমিকদের দেবতা গনেশ। গণ + ঈশ = গনেশ। জনগনের ঈশ্বর।

কলাবউঃ নবরত্ন বা নয়টি শস্য দিয়ে কলাগাছে বেঁধে নতুন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। প্রকৃতির যে শস্য গুলো মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়- এমন ৯ টি শস্য। (যেমন- ধান, পাট, বেল, কলা, সরিষা ………)

অসুরঃ সুর মানে যেটা কানে ভাল লাগে বা শুভ। কাজেই অসুর মানে যা সুরে যায় না,অশুভ। যা মানুষের কল্যাণ করে না। সমাজের ক্ষতি কারক চিন্তা বা শক্তি। তাহাই অসুর।

বাহন পরিচিতিঃ
বাহন কি?
যে বহন করে। অর্থাৎ কিনা যে প্রাণীর মধ্যে এই শক্তি বাহিত হচ্ছে সে হচ্ছে বাহন।
সিংহ-পরাক্রম শক্তি, ধীশক্তি, রাজশক্তি, সংগঠিত শক্তি।
রাজহাঁস- বিবেক। শুভ-অশুভ বিচার করে শুভ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জল আর দুধ একসাথে মিশে দিলে রাজহাঁস জল থেকে দুধকে পৃথক করে খেতে পারে।
ময়ূর- সকল পাখির মধ্যে সুন্দর। সব পাখি তাকে পছন্দ করে। নেতৃত্ব দিতে পারে। স্থির।
পেঁচা- ধন আগলে রাখতে পারে।
ইঁদুর- পরিশ্রম এর প্রতীক। দিনরাত পরিশ্রম করে। শুধু পরিশ্রম করে যায়।
মহিষ- ক্রোধ, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি অশুভের-এর প্রতীক। মহিষ একবার রেগে গিয়ে শুয়ে পড়লে আর তাকে উঠানো দায়- এমন জেদ।

আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজার আয়োজন কেন?
বঙ্গদেশের প্রধান কৃষিকাজ হত আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের মধ্য পর্যন্ত। এ সময় ধান লাগানোর পরে কৃষকের ঘরে আর কাজ থাকে না। ধান পাকবে অগ্রহায়ণে। কি করবে মানুষগুলা এই তিন মাস? বসে থাকলে তো শয়তান ভর করবে। তাই উৎসবের আয়োজন করা হয়। পূজা কেন? তখন হিন্দু সম্প্রদায় বেশি ছিল। ঈশ্বরিয়ভাবে মেতে ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে উৎসব করার জন্য এবং এই তিন মাস কাজ করতে গিয়ে অনেকের সাথে মতের পার্থক্য হওয়ায় মতৈক্য সৃষ্টির জন্য বা সৌহার্দ তৈরি করতে এই পূজার আয়োজন। তাই বসন্ত কালের বাসন্তিকে অকালবোধন করা হল। এই পূজা শুধু বাঙ্গালিরাই করে। তাই বলা যেতে পারে এটা বঙ্গদেশের পণ্ডিতদের আবিষ্কার। সোজা কথায় বাঙ্গালির উৎসব।

এই পূজার উদ্দেশ্য কি?
এই পূজার দ্বারা মানুষে মানুষে ভাত্রিত্ব বৃদ্ধি হয়, সৌহার্দ বৃদ্ধি হয়, মতৈক্য তৈরি হয়। সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক বৃত্ত সচল থাকে।

দুর্গাপূজা সার্বজনীন কেন?
এই পূজার মধ্যে সব রকম পেশার মানুষের অংশ গ্রহণ থাকে বলে এটিকে সার্বজনীন পূজা বলা হয়। তাঁতিরা কাপড় বোনে। মেয়ে-জামাই আসে ঘরে, শিশুরা নতুন কাপড় পড়ে, কুমারেরা নতুন ভাবে শৈল্পিক দৃষ্টি দিয়ে নুতন প্রতিমা বানায়, ভাস্কর্য করে, খেলার পুতুল বানায়। গায়ক নতুন গান বাঁধে। নটরা নতুন নাটক বানায়- সকল শিল্পীরা তাদের শিল্পকলা দেখানোর সুযোগ পায়। দেশের সংস্কৃতির ধারা তৈরি হয়। ফলে সকল পেশার মানুষ অংশ নিয়ে সার্বজনীন ভাবে ব্যস্ততায় সময় কাটায়। উৎসব গুলো শেষ হতে না হতেই ধান পাকে। তখন ধান কাটা শুরু হয়। আবার কাজের মধ্যে ডুবে যায় মানুষ। আসে নবান্ন উৎসব। আবার সবাই মিলে একসাথে মেতে উঠে নতুন চালের পিঠা খাওয়ার আনন্দে। সমাজের আকাশে মিলনের সুর বাজে। সমাজ হয় অসুরমুক্ত।1371261_377260375710974_324044704_n