মুহুর্মুহু স্লোগানে শাহবাগে শনিবারের বিকেলটি প্রকম্পিত করে সাকিব-মুশফিকদের টেস্ট খেলার অধিকার টিকিয়ে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশীরা। ‘এক দাবী এক দেশ, টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ’, ‘তিন মোড়লের দালালী, মানি না মানবো না’, ‘ক্রিকেটের ওপর হামলা, রুখে দাও বাংলা’…এমন অসংখ্য স্লোগানে গলা মেলালেন উপস্থিত সহস্রাধিক জনতা।
ক্রিকেট বিশ্বের তিন পরাশক্তি ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির তথাকথিত সংস্কারের আড়ালে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ ও টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভাজন পদ্ধতির নামে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার হীন প্রয়াসের প্রতিবাদে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের ডাকা মানববন্ধন কর্মসূচী রীতিমতো জনসমুদ্রের রূপ নেয়।
মূলত তরুণদের এই সমাবেশে ছোট্ট শিশু এসেছিল বাবার কাঁধে চড়ে, স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন মধ্যবয়সী মা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ব্যানারে সদলবলে হাজির হয়েছেন শিক্ষার্থীরা, সশরীরে প্রতিবাদ জানাতে সুদূর সিলেট-চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্রিকেটপাগল জনতার উপস্থিতিতে শাহবাগ যেন পরিণত হয়েছিল এক টুকরো বাংলাদেশে।
বিকেল চারটায় কর্মসূচী শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তিনটার পর থেকেই শাহবাগ মোড় সংলগ্ন জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিভিন্ন দাবী সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন ও জাতীয় পতাকা নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। বেলা বাড়ার সংগে সংগে বাড়তে থাকে জনসমাগম। রাস্তার দু’পাশে সুশৃঙ্খল মানববন্ধন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ছাড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মূল ফটক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে।
সমাবেশে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাহিদ বাংলা টেলিগ্রাফকে বলেন, “ফেসবুকে পুরো বিষয়টা পড়ে স্থির থাকতে পারছিলাম না। জানি না এই কর্মসূচীতে কতটুকু কি হবে কিন্তু সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতাটুকু মেটালাম।” একটি বেসরকারি সংস্থার প্রকল্প পরিচালক মোঃ হাসান মনে করেন দেশের ক্রিকেটের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের রাজপথে নেমে আসা উচিৎ। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থী লাবণীর মন্তব্য, “প্রায় প্রতিটা ইস্যুতে বিভক্ত এই জাতি একমাত্র ক্রিকেটকে নিয়েই এখনও সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে উৎসব করতে পারে। সেই ক্রিকেটের উপর এমন অশনিসংকেত কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।” অন্যায্য এই প্রস্তাবনা বাতিলের দাবীতে নিজের অবস্থান থেকে সোচ্চার থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন বুয়েট ছাত্র তাহমিদ।
প্রদর্শিত শত শত ব্যানার-ফেস্টুনেও ফুটে উঠেছে ক্রিকেটপাগলদের ভাঙা হৃদয়ের হাহাকার, ঘৃণা আর আর্তনাদ। ‘আমাদের ক্রিকেটকে নয়, আমাকে খুন করুন’, ‘টাকা চাই না, খেলতে চাই’, ‘তিন শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেবো না’, ‘ক্রিকেট কোন পণ্য নয়’ প্রভৃতি বাংলা ভাষায় লেখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণে ছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইংরেজী প্ল্যাকার্ডঃ ‘We live on cricket, don’t kill us’, ‘No dictatorship in cricket’, ‘No hope for cricket race’, ‘BCCI go home, you are drunk’। বার্তা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উদ্দেশ্যেওঃ ‘BCB is Bangladesh Cricket Board, Not Business corporation of Bangladesh’, ‘BCB say no to all unfair demands, Save Bangladesh cricket’।
কর্মসূচীর অন্যতম আয়োজক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তানজির ইসলাম বৃত্ত ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে কর্মসূচী সফল করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে শিগগিরই পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলে জানান।
এদিকে বোর্ড পরিচালকদের সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিসিবি তিন বোর্ডের প্রস্তাবনা সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিলেও ক্রিকেটপ্রেমীদের কড়া সমালোচনা ও তীব্র প্রতিবাদের মুখে সংস্থাটি তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন আইসিসির সভায় বিসিবির পক্ষ থেকে টেস্ট ক্রিকেট বিভাজনের আলোচ্য প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হবে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস।
উল্লেখ্য ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, টেস্ট র্যা ঙ্কিংয়ের ৯ ও ১০ নম্বরে থাকা দল টেস্ট ক্রিকেটে অংশ নিতে পারবে না। তাদের খেলতে হবে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সাথে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে। ওই টুর্নামেন্ট জিতলে সিরিজ খেলার সুযোগ মিলবে র্যা ঙ্কিংয়ে আট নম্বরে থাকা দলের বিরুদ্ধে। সে সিরিজ জিতলে তারপরই খেলা যাবে র্যা ঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে। বর্তমান টেস্ট র্যা ঙ্কিংয়ে ৩৪ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে ৯ নম্বরে আছে জিম্বাবুয়ে, ১৮ পয়েন্ট নিয়ে দশে বাংলাদেশ। ২৮-৩০ জানুয়ারী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য আইসিসির নির্বাহী কমিটির সভায় এ প্রস্তাব উত্থাপন করার কথা রয়েছে যা অনুমোদন পেলে এক যুগ বয়সী বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অনিবার্যভাবেই ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।





























