শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ৩ নভেম্বর ২০২৫, ৬:০৫ অপরাহ্ন
শেয়ার

মধ্যযুগে অভিজাতদের জুতোর অগ্রভাগ সুঁচালো ও দীর্ঘ হতো কেন!


Shoe cover

ছবি : সংগৃহীত

একটু মনে করে দেখুন তো, নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় কিংবদন্তী অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে কেমন জুতো পরতে দেখেছেন? বেশ লম্বা জুতো, সামনের দিকটা সরু ও সুঁচালো। মুঘল-এ-আজম সিনেমায় পৃথ্বীরাজ কাপুরের জুতোও তাই। আসলে রাজা-বাদশাহদের জুতোগুলো এমনই হতো। কিন্তু কেন? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

মধ্যযুগে অভিজাতবর্গের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলো ‘ক্র‍্যাকোস’ নামে এক ধরণের জুতো। পওলেইন বলেও পরিচিত ছিলো এটি। সম্রাট ও অমাত্যবর্গের পায়ে শোভা পেতো এই জুতো। অগ্রভাগটি হতো বেশ সুঁচালো ও লম্বা। পায়ের আঙ্গুল থেকে আরো অন্তত ২০ ইঞ্চি সামনে পর্যন্ত বিস্তৃত হতো এর সুঁচালো অগ্রভাগ।

চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকজুড়ে প্রায় ১৫০ বছর ধরে এই জুতোগুলো ছিলো তৎকালীন ফ্যাশনের অংশ। পোলান্ডের ক্র‍্যাকোও শহরে প্রথম তৈরি হয় এই জুতো, নামও হয় সেই শহরের নামের অনুসরণে- ‘ক্র‍্যাকোস।’ ইউরোপে দামি এই জুতো শোভা পেতো বিত্তবানদের পায়ে। মস বা ঘাস জমিয়ে নিয়ে দেওয়া হতো তাদের আকৃতি। ফলে অনেক লম্বা হলেও জুতো বেঁকে যেতো না।

অনেক সময় এই জুতোগুলো তৈরি হতো চামড়া দিয়ে। থাকতো নকশা ও অন্যান্য সাজসজ্জা।

Shoe Inner 3

ছবি: সংগৃহীত

কারো পায়ে এই জুতো থাকা মানেই সে ব্যক্তি অভিজাত- এমনই মনে করা হতো সে সময়। অতি দামি ঘড়ি, প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি ও প্রাইভেট জেট বিমান থাকাটা যেমন এখন ঐশ্বর্যের চিহ্ন, এই জুতোও সেসময় ছিলো তেমনই।

জুতোর সুঁচালো অগ্রভাগ যত দীর্ঘ হতো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ততোই অভিজাত মনে করা হতো। অতি লম্বা এই জুতো পায়ে থাকলে ব্যক্তিদের পক্ষে তেমন কোনো শারীরিক শ্রমের কাজ করা সম্ভব ছিলো না। এর সঙ্গে সোনা বা রূপার চেইন বেঁধে দেয়া হতো কখনো কখনো। মূলত এই জুতো আভিজাত্যের পাশাপাশি আলস্যেরও চিহ্ন ছিলো। তাছাড়া, শারীরিক পরিশ্রমের কাজকে সে সময়ের অভিজাতবর্গ খুব নিচু মানের ও নিজেদের মর্যাদার পক্ষে হানিকর মনে করতেন।

মূলত পুরুষদের জন্য তৈরি হলেও নারীদেরও ব্যবহার করতে দেখা গেছে এই জুতো। জুতোর বেধ বা উচ্চতা কম থাকায় এতে পায়ের বড় একটি অংশ উন্মুক্ত থাকতো। ফলে সৌন্দর্য প্রকাশের জন্যও ছিলো এর চাহিদা।

Shoe Inner 4

ছবি: সংগৃহীত

লন্ডন জাদুঘরের সিনিয়র কিউরেটর জ্যাকি কেলির মতে, এই জুতো যে সময়ে জনপ্রিয় হয়েছে, সেটি বিউবোনিক প্লেগ ও ‘ব্ল্যাক ডেথ’ থেকে খুব দূরের নয়। সে সময় প্লেগে ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলো। সামাজিক ও মানসিক দৈন্য ঢাকতেও অভিজাতদের ভেতর নানারকম জাঁকজমকের প্রচলন হয়েছিলো।

কিন্তু এতো দীর্ঘ সময় কেনো এই জুতো জনপ্রিয় ছিলো? এর কারণ, সে সময় কোনো ‘ট্রেন্ড’ চালু হলে নানান শহরে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগতো। এখনকার মতো টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তখন ছিলো না। সে সময় কোনো ফ্যাশন অনুষঙ্গ অভিজাতদের ভেতর চালু হতো। কালক্রমে ছড়িয়ে যেতো অন্যান্য শ্রেণিতে। মফস্বল বা গ্রামে এর প্রচলন ঘটতো আরো দেরিতে।

Shoe Inner 1

তবে এই জুতো সময়ের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে হারিয়ে যায়নি। ১৪৬৩ সালে রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ড এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। কারণ, হাঁটার সময় এতে তৈরি হতো অপ্রীতিকর শব্দ। সামনের সুঁচালো অগ্রভাগ দুই ইঞ্চির ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে ১৩৬৮ সালে প্যারিসে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। এই জুতো পরে প্রার্থনায় অংশগ্রহণে সমস্যা হওয়ায় রাজা পঞ্চম চার্লস একে নিষিদ্ধ করেন। ১৪৭৫ সালের ভেতর ফ্যাশন থেকে ছিটকে পড়ে এই জুতো।

তবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ডে এর একরকম পুনর্জন্ম হয়। ‘উইংকলপিকার’ নামে চালু হওয়া চটি জুতোগুলো মধ্যযুগের পওলেইনের মতো অত সূঁচালো ও দীর্ঘ ছিলো না। তবে গঠণের দিক থেকে মধ্যযুগের সেই রাজকীয় জুতোর সঙ্গে সাদৃশ্য ছিলো এর।