
বিশ্বায়নের এ যুগে পৃথিবী একদিকে যেন হাতের মুঠোয়—ইন্টারনেট, প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ আমাদের প্রতিদিন নতুনভাবে যুক্ত করছে। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই সীমান্তগুলোতে কড়াকড়ি যেন আরও বাড়ছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ, পড়াশোনা কিংবা কাজের সুযোগ পেতে হলে যে কাগজপত্রের জটিলতা পেরোতে হয়, তা-ই আদতে ভিসা। অনেকের কাছে ভিসা কেবল একটি ভ্রমণের অনুমতিপত্র হলেও, Migration Policy Institute এর ২০২১ সালে দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী আসলে এটি একটি দেশের নিরাপত্তা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক বিভিন্ন দেশগুলোর ব্যাপারে একটি দেশের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
ভিসানীতির শুরু, শেষ আর পরিবর্তন
পশ্চিমা বিশ্বের ভিসানীতি শেকড় গেড়ে আছে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের সময়কাল থেকে। খুঁজতে গেলে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন থেকেই খুঁজতে হবে। যুদ্ধশেষে ইউরোপের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল, আর তখনই শুরু হয় শ্রমশক্তি আমদানি। জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাজ্যে সেই সময়ে অভিবাসীরাই ছিলেন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এবং এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে (IFO Institute, 2018) এর বার্ষিক প্রতিবেদনের গবেষণা প্রবন্ধ।
কিন্তু স্নায়ু যুদ্ধের সময় চিত্রটা বদলাতে শুরু করে। পূর্ব-পশ্চিম ব্লকের লড়াইয়ে সীমান্তে নজরদারি বাড়তে থাকে। আর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর ভিসানীতি হয়ে ওঠে মূলত নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক। আমেরিকা ভ্রমণ করতে চাইলে এখন কেবল উদ্দেশ্য বোঝালেই হয় না; প্রতিটি আবেদনকারীর অতীত, বর্তমান এমনকি সম্ভাব্য ভবিষ্যতও খুঁটিয়ে দেখা হয় (US State Department, 2023)। এখন তো তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল আনলক করে রাখাও বাধ্যবাধকতার মধ্যে রেখেছে।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের নীতি নতুন করে কঠোর হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে অবাধ চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়, আর বিশ্বজুড়ে অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে লন্ডন তৈরি করে পয়েন্ট-ভিত্তিক একটি ব্যবস্থা European Commission, 2024 এর রিপোর্ট অবলম্বনে এই কথা বলাই যায়। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে ভিসানীতির পরিবর্তন স্পষ্ট করে দেয়-এটি কেবল কাগজ নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ।

ভিসার ধরণ ও বাস্তবতা
আজকের দিনে ভিসার ধরণ অনেক বৈচিত্র্যময়-
ট্যুরিস্ট ভিসা: ভ্রমণের আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সীমিত সময় ও কঠোর শর্ত।
স্টুডেন্ট ভিসা: পড়াশোনার সুযোগ, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রিনিউয়াল, কাজের অনুমতি ও পোস্ট-স্টাডি পারমিটের জটিলতা (British Council, 2022)।
ওয়ার্ক ভিসা: দক্ষ শ্রমশক্তিকে স্বাগত জানালেও, অদক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে নীতি কঠিন (Migration Policy Institute, 2021)।
শরণার্থী বা আশ্রয় ভিসা: যুদ্ধ, দমন-পীড়ন বা জলবায়ু বিপর্যয়ে পালিয়ে আসা মানুষের জন্য, তবে এর পেছনেও রয়েছে কড়া রাজনৈতিক সমীকরণ (OECD, 2019)।
আঞ্চলিক পার্থক্য
একই পশ্চিমা বিশ্ব হলেও দেশভেদে ভিসানীতির চিত্র একেবারে আলাদা।
আমেরিকা: Diversity Visa (DV) এখনো স্বপ্ন জাগায়, কিন্তু B1/B2 বা H1B ভিসার ক্ষেত্রে রিজেকশনের হার অনেক বেশি। ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার আবেদনকারীদের জন্য B1/B2 ভিসার “adjusted refusal rate” ছিল প্রায় ৩০% (US State Department, 2023 এর তথ্যমতে)। আর সম্প্রতি সবথেকে উল্লেখযোগ্য একটা ডেভলপমেন্ট ছিল, ইউএস H1B ভিসায় ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে এক লাখ ডলার। এবং আরো উল্লেখ্য যে, এই ভিসার সবথেকে বড় ভোক্তা ছিল ভারতীয়রা। তো এক হিসেবে এটাও বলে দেয়া যায় যে, এটিও ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই।
শেনজেন অঞ্চল: এক ভিসায় ২৭টি দেশে প্রবেশের সুবিধা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শক্তি। তবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের জন্য রিজেকশন রেট ছিল প্রায় ৫৪.৯% (European Commission, 2025)। আফ্রিকান দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এ হার ৪০–৫০% ছাড়িয়েছে (Henley & Partners, 2025)।
যুক্তরাজ্য: পয়েন্টভিত্তিক সিস্টেম এখন নির্ধারণ করে কে দেশে প্রবেশ করতে পারবে, আর কে পারবে না। দক্ষ কর্মী ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পায়, বাকিরা পড়েন জটিলতায় (Migration Policy Group, 2021)।
কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া: তুলনামূলক অভিবাসীবান্ধব ইমেজ ধরে রেখেছে। বিশেষ করে দক্ষ শ্রমশক্তি ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য পথ তুলনামূলক সহজ (Henley & Partners, 2024)।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও জনমত
ভিসানীতির পেছনে লুকিয়ে থাকে বড় রাজনীতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিংবা ইউরোপের সংসদীয় ভোটে অভিবাসন নীতি প্রায়ই মূল ইস্যু হয়ে ওঠে। একদিকে দক্ষ শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণ করতে পশ্চিমা দেশগুলো অভিবাসীদের চায়, আবার অন্যদিকে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব সরকারগুলোকে নীতি কঠোর করতে বাধ্য করে (OECD, 2019)। সবই আসলে ব্যবসা আর রাজনীতি-কূটনীতিরই খেলা।
অর্থনীতিও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। শ্রমবাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী ভিসা খোলা বা বন্ধ হয়। তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা বা প্রকৌশল খাতে দক্ষ জনবলকে টানতে উদার নীতি গ্রহণ করা হলেও, কম দক্ষ খাতে নীতি কঠোর রাখা হয় (IFO Institute, 2018)।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশিদের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের ভিসা পাওয়া সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে শেনজেন ভিসার রিজেকশন রেট ২০২৪ সালে প্রায় ৫৫% (European Commission, 2025)। অনেক শিক্ষার্থী স্বপ্ন নিয়েই আবেদন করে, কিন্তু নানা কারণে তা আটকে যায়—অর্থনৈতিক প্রমাণ যথেষ্ট নয়, পড়াশোনার পরিকল্পনা অস্পষ্ট, কিংবা সন্দেহ হয় আবেদনকারী পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরবেন কি ফিরবেন না (The Business Standard, 2024)।
ওয়ার্ক ভিসার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। দক্ষ শ্রমশক্তির জন্য কিছু পথ খোলা থাকলেও, অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমা দেশগুলো এখন প্রায় অচল। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থীদের ভিসা নীতি আরও কঠোর হয়ে উঠেছে, যার ফলে অনেকেই বিকল্প হিসেবে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঝুঁকছে (British Council, 2023) (Henley & Partners)।
ভিসা হলো আধুনিক বিশ্বের এক অদৃশ্য দেয়াল। প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দুনিয়া যতই একীভূত হোক না কেন, এই দেয়াল ভেদ করে অন্য দেশে প্রবেশ করা আজও সহজ নয়। ভিসানীতি একদিকে নিরাপত্তা, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিফলন, আবার অন্যদিকে সাধারণ মানুষের স্বপ্নপূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা।
ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রিমোট ওয়ার্ক কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে অভিবাসনের প্রবাহ নতুন রূপ নেবে। তখন হয়তো আজকের এই কঠোর নীতিরও নতুন চেহারা আসবে। কিন্তু আপাতত ভিসাই রয়ে গেছে হয়ে সীমান্তের সবচেয়ে দৃঢ় প্রহরী।




























