
শব্দ আর তার অভাবে আমরা শুধু শুনছি না, দেখার অভিজ্ঞতায়ও বিপর্যস্ত হচ্ছি
একসময়ে পার্থিব পৃথিবী ছিল এমন এক ভুবন, যেখানে রাতের স্তব্ধতায় পূর্ণিমার নিঃশব্দতা, পাখির ডাক, ঝর্ণার ঢেউয়ের মৃদু কল-কল শব্দ শোনা যেতো। কিন্তু আজ এই নিস্তব্ধতা পালাচ্ছে আর মানুষ পালাচ্ছে শব্দ থেকে।
শব্দ আর তার অভাবে আমরা শুধু শুনছি না, দেখার অভিজ্ঞতায়ও বিপর্যস্ত হচ্ছি। শব্দ-লয় পাল্টেছে, শহর বদলেছে, আমাদের মনস্তত্ত্ব বদলেছে।
শব্দ-মানব সম্পর্কের ইতিহাস
কানাডীয় সংগীতজ্ঞ-শব্দবিশারদ R. Murray Schafer “soundscape” ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো পরিবেশের শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা আর ইতিহাস।
শব্দ শুধুই শোনা যায়, এতোটুকুতেই শেষ- ব্যাপারটা এমন নয়। শব্দ আমাদের সমাজ, মূল্যবোধ ও জীবনধারার অংশ। বন বা গ্রামীণ মাঠ যেমন ছিল নিস্তব্ধতার আবাস, আধুনিক শহর হয়ে উঠেছে শব্দের কোলাহল-মহল।
শব্দদূষণ ও শহুরে বিপর্যয়
আজকের শহর আর আগেকার দিনের গ্রাম নয়। যানজট, বিমান- উড্ডয়ন, ঢালাই মেশিন, মেগা ইভেন্টের মাইক্রোফোন- এসব শব্দ এমন স্তরে পৌঁছেছে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শুধু শ্রবণশক্তি নিয়ে সমস্যা ভোগ করতে হচ্ছে এটুকুই নয়— উচ্চ রক্তচাপ, ঘুম বিঘ্নিত হওয়া, মনোযোগ হারিয়ে যাওয়ার মতো দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যপ্রভাব দেখা গেছে উচ্চ শব্দের কারণে।

শব্দের এই প্রবলতা শুধু পরিবেশে নয়—মানুষের ভিতরে এক ধ্বংসাত্মক ঢেউ তৈরি করছে। শহুরে নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ, ঘুমহীনতা, বিষণ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে। শব্দ এখন অভাবের নয় বরং অতিপ্রাচুর্যের কারণ। লাইনটা বোধ হয় ভুল পড়েছেন? অতি প্রাচুর্যতার ল্যাভিশ শো অফ ইদানিং শব্দ বৃদ্ধির কারণ। আবার কাউকে কাউকে চির অভাবী বানিয়ে দিচ্ছে, সুখের অভাবী।
নিঃশব্দতার থেরাপি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
ইতিহাসের পালাক্রমে শব্দ এমন মাত্রায় বেড়েই চলছে যে, নীরবতা কিংবা নীরব কোনো স্থান নগর জীবনে খুঁজে পাওয়া যেন অমাবস্যার চাঁদ খুঁজে পাওয়ার মতোই দুষ্কর। এমন সব সমস্যা এড়াতেই মূলত Schafer প্রস্তাব করেছিলেন “acoustic design” বা শব্দ-পরিস্থিতির ডিজাইনের, যেখানে নীরবতাকেও পরিকল্পিতভাবে রাখা যাবে। অর্থাৎ, শব্দকে একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাবে!
কৃষ্ণবর্ণায়তে যেমন বলা হয়েছে— সম্পূর্ণ নিঃশব্দতায় না মেলে মন- না মস্তিষ্ক দেয় বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ।

ইদানিংকালে “নীরবতার থেরাপি” নামে নতুন এক প্রবণতা দেখা দিচ্ছে — সপ্তাহে একদিন ‘নীরব ঘণ্টা’, ‘সেন্ট্রাল পার্কের চুপচাপ ঠান্ডা পরিবেশ’, ‘হেডফোন বাদ দিয়ে প্রেস বাটনে প্লে না করা গান’ এসবের অভ্যাস বাড়ছে। কারণ মানুষ বুঝছে—শব্দের উত্তেজনায় মন স্থির থাকে না, আবেগ ঠিকঠাক ফাংশন করে না, চিন্তা স্পষ্ট হয় না।
অর্থ, সংগীত ও মানব-সংযোগের দিকনির্দেশ
শব্দ শুধুই কোলাহল নয়; শব্দ এক অনুভূতি, কখনও কখনও শব্দই রাজনৈতিক বক্তব্য, রাজনৈতিক বার্তা, সামাজিক মুক্তির মাধ্যমও। সঙ্গীতের রাজনীতি হিসেব করলে দেখা গেছে— শব্দ (বা শব্দের অনুপস্থিতি) মানুষের অধিকার-আন্দোলন ও দাবি আদায়ে ভূমিকা নিয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ, নাগরিকরা যখন বিমান উড়োজাহাজের ধ্বনিতে হয়রান হয়, শব্দ প্রতিবাদ-আন্দোলনের অংশ হয়। শব্দ বাড়লে মানুষ নিরাপত্তাহীন মনে করে, শান্ত পরিবেশ হারায়। তাই নিঃশব্দতা কখনো বিলাসিতা নয়—বরং মানবাধিকারের বিষয়।

নীরবতা ও শব্দ—মানব সভ্যতার দুই ধ্রুবক
আমরা এখন এমন এক যুগে রয়েছি, যেখানে শব্দ অভাব নেই আর—অতিরিক্ত। কিন্তু নীরবতা যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে শোনা যায় মনের গভীর সুর, অনুভূতির নিস্তব গন্ধ। কখনও কখনও শোনা যায় এমন কিছু , যা শব্দে্র ভাষায় শোনা যায়না।
এখন প্রশ্ন হলো- কীভাবে আমরা শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করবো, আর নীরবতাকে পুনরায় নিজেদের মধ্যে নতুন চর্চা হিসেবে ছড়িয়ে দিতে পারবো?
সাধারণভাবে বললে—নীরবতা আমাদের অনুপ্রেরণা, পুনরুজ্জীবন ও বিবেকের শব্দ। শব্দ যখন বিরোধিত হয়, তখন আমরা আসলে নিজেকে শুনতে শিখি।
শব্দের ইতিহাসই হয়ে উঠছে আমাদের পরবর্তী যুদ্ধভূমি—যেখানে নীরবতা শুধু বিলাসিতা নয়, বেঁচে থাকার অধিকার।
সুতরাং — নীরবতা খুঁজুন, শুনুন নিজেদের ভিতরে, কারণ সেখানে আজও বাস করছে সভ্যতার এক অনুরণন।




























