
জয়পুরহাটে জিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে রোগীদের ভিড়।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় ‘জিন’ দিয়ে রোগ নির্ণয়, ভবিষ্যৎ বলা ও চিকিৎসা দেওয়ার অবিশ্বাস্য প্রতারণার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার পুনট ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে জাহেরা বিবি (ডাক নাম ‘বানেছা পরী’) নামে এক নারী ও তার পরিবার প্রায় এক দশক ধরে এ ঘৃণ্য অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এদের ‘জিন চিকিৎসালয়’-এ ক্যান্সার, টিউমার, সন্তানহীনতা ও মানসিক রোগের মতো গুরুতর ব্যাধির চিকিৎসার আশায় শত শত মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।
জাহেরা বিবি দাবি করেন, তার মাধ্যমে জিন স্বয়ং রোগ নির্ণয় করে, চিকিৎসা দেয় এবং ভবিষ্যৎ বলে দেয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বানেছা পরীর বাবা আবুল হোসেন এবং বোনের স্বামী জাহিদুল ইসলাম মিলে এ জিনের চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। সপ্তাহে চার দিন এখানে রোগী দেখা হয়। সিরিয়ালের জন্য দিতে হয় ৩০ টাকা। এরপর শুরু হয় তেল পড়া, পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক এবং সবচেয়ে হাস্যকরভাবে আঙুল দিয়ে ইনজেকশন দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে ‘শেষ পর্যায়ে’, ‘জিনের খপ্পরে’ বা ‘আর বাঁচবে না’ বলে ভয় দেখানো হয়। এরপর শুরু হয় আসল প্রতারণা। দর-কষাকষি করে রোগীর অবস্থা বুঝে ৫ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। যার শারীরিক অবস্থা যত করুণ, তার কাছ থেকে দাবি তত বেশি।
চিকিৎসা নিতে আসা কোরবান আলী এবং জহুরা বেগমের মতো অনেকেই লোকমুখে শুনে আশায় এখানে এসেছেন। জহুরা বেগম তো হাত ভাঙার জন্য হাসপাতালেও না গিয়ে জিন দিয়ে সারানোর চেষ্টা করছেন!
এ বিষয়ে খবর সংগ্রহ করতে গেলে জাহেরা বিবি, তার বাবা আবুল হোসেন ও বোনের স্বামী জাহিদুল ইসলামসহ তাদের লোকজন সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। কীভাবে চিকিৎসা করেন—এমন প্রশ্নে তারা জানান, “তাদের টাকার দরকার, পারলে তাদের ব্যবসা বন্ধ করেন।” প্রতারক চক্রের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যে তাদের অপকর্মের বিষয়ে কোনো ভয় নেই বলেই প্রতীয়মান।
এলাকাবাসী, যেমন গোলাম রসুল ও মাহতাব আলী প্রামাণিক, স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, এই কার্যক্রম ইসলামবিরোধী, অমানবিক এবং সম্পূর্ণ আইনবিরোধী। তারা বহুবার প্রশাসনকে জানালেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি জাহেরা বিবি নিজেই দাবি করেন, প্রশাসনের লোকজন নিয়মিত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মাহফুজ আলম এটিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও প্রতারণামূলক উল্লেখ করে বলেন, “চিকিৎসা দেওয়ার অধিকার কেবলমাত্র রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকদের রয়েছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক হুমকি।”
তবে এ বিষয়ে কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হোসেন জানান, “আমি এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম জানলাম। এটি অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিমা আক্তার জাহান জানান, এমন প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে এবং তিনি এলাকাবাসীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
প্রশাসনের এমন আশ্বাসের পরও, প্রায় এক দশক ধরে চলমান এ প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে কবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং সাধারণ মানুষ কবে এর ভয়াল গ্রাস থেকে মুক্তি পায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।




























