
দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে আফগানিস্তান আর পাকিস্তান একে অপরের প্রতিবেশী, কিন্তু সম্পর্কটা কখনোই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। সীমান্তে একের পর এক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, আর পারস্পরিক সন্দেহ যেন এই দুই দেশের স্থায়ী বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের অক্টোবরেও সেই পুরোনো উত্তাপ আবার জ্বলে উঠেছে—সীমান্তে গুলি, বোমা হামলা, এমনকি সাময়িক যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়া। প্রশ্ন উঠছে—এই সংঘাতের শিকড় কোথায়? কেন এতো বছরের পরেও শান্তি আসছে না? আর ভবিষ্যতে এটা কোন দিকে গড়াবে?
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট: সীমান্তে নতুন আগুন
২০২৫ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তান–আফগান সীমান্তে ভয়াবহ গোলাগুলির খবর আসছে। পাকিস্তানের দাবি, আফগানিস্তানের ভেতর থেকে ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) নামের জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের সেনা ও পুলিশকে টার্গেট করছে। তারা বলছে, তালেবান সরকার এসব গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে। অন্যদিকে, কাবুলের তালেবান প্রশাসন বলছে—পাকিস্তান বারবার আফগান ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালাচ্ছে, যা তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত।

ছবি: গেইটি ইমেজেস
দু’দেশের সীমান্ত এলাকাগুলো—বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান ও স্পিন বোলদাক অঞ্চলে—একের পর এক গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছেন, শতাধিক আহত। কয়েকবার অস্ত্রবিরতির ঘোষণা হলেও তা আদতে টেকেনি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলছে, তারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ চালাচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান বলছে, এগুলো ‘বেপরোয়া হামলা’। এই পারস্পরিক অভিযোগের ভেতরেই আবার পুরোনো অবিশ্বাসের ছায়া ফিরে এসেছে।

ডুরান্ড লাইন, ছবি: জিকে টুডে
পুরোনো ইতিহাস: ডুরান্ড লাইন থেকে বর্তমান
পাকিস্তান–আফগান সম্পর্কের সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। এর শুরু প্রায় ১৩০ বছর আগের এক চুক্তি থেকে।
ডুরান্ড লাইন– বিভাজনের বীজ
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারত ও আফগান শাসক আবদুর রহমান খান ‘ডুরান্ড লাইন’ (Durand Line) নামের এক সীমান্তরেখা টানেন। এই রেখা বর্তমান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝখান দিয়ে গেছে। সমস্যা হলো—এই রেখা পশতুন গোত্রকে দুই দেশে ভাগ করে ফেলেছিল। আফগানিস্তান কখনো এই সীমান্তকে বৈধ বলে মেনে নেয়নি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরও আফগানিস্তান সেই একই অবস্থানে থাকে। এমনকি জাতিসংঘে পাকিস্তানের সদস্যপদ মেনে নিতে প্রথমে আফগানিস্তান আপত্তি জানায়। তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল অবিশ্বাস দিয়ে।
পশতুনিস্তান আন্দোলন ও সীমান্ত টানাপোড়েন
১৯৫০ এর দশকে আফগানিস্তানে ‘পশতুনিস্তান’ নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়। তারা চেয়েছিল, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশের পশতুন অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো আলাদা হয়ে একটি নতুন দেশ হোক। পাকিস্তান এই দাবিকে রাষ্ট্রবিরোধী মনে করে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে। সেই থেকেই দুই দেশের মধ্যে সন্দেহের দেয়াল আরও উঁচু হয়।
সোভিয়েত আগ্রাসন ও পাকিস্তানের ভূমিকা
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। তখন পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে আফগান মুজাহিদিনদের (বিদ্রোহী যোদ্ধা) প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ ও পাকিস্তানের ‘আইএসআই’ একসঙ্গে কাজ করেছিল।
এই সময় পাকিস্তান প্রায় ৩০ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সেই শরণার্থীদের অনেকেই আর ফিরে যায়নি। সীমান্ত অঞ্চলে অস্ত্র, জঙ্গি ও মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে।
তালেবান যুগের উত্থান
১৯৯০ এর দশকে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের মধ্যে তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। পাকিস্তান তখন এই গোষ্ঠীকে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়, কারণ তারা বিশ্বাস করত—তালেবান শাসন মানে আফগানিস্তানে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সরকার প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখল করে, এবং পাকিস্তান তাদের অন্যতম প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ হয়।
কিন্তু ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ (নাইন ইলেভেন) হামলার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তালেবান সরকার পতন হয়, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে, এবং পাকিস্তানকে বাধ্য হয়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ অংশ নিতে হয়। অথচ এই যুদ্ধে পাকিস্তানের ভেতরে অনেকেই তালেবানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
ফলে এক অদ্ভুত দ্বিমুখী পরিস্থিতি তৈরি হয়—পাকিস্তান একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, অন্যদিকে তালেবানদের অঘোষিত আশ্রয়দাতা।
তালেবানের প্রত্যাবর্তন
২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসে। তখন পাকিস্তান ভেবেছিল, এবার হয়তো তাদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণ হবে—একটি মিত্র তালেবান সরকার তাদের পাশে থাকবে।
কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টোটা। আফগানিস্তান তালেবান শাসনের অধীনে স্বাধীন নীতি নিতে শুরু করল। তারা পাকিস্তানের কথায় আর আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না। বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টিটিপি নামের গোষ্ঠীগুলোর হামলা বেড়ে গেল।
এখন পাকিস্তান নিজেই সেই আগুনে পুড়ছে, যেটি একসময় তারা জ্বালিয়েছিল।

ধ্বংসস্তুপের সামনে আফগান যোদ্ধা ।। ছবি: রয়টার্স
সংঘাতের মূল কারণ: অবিশ্বাস, সন্ত্রাস আর সীমান্ত দ্বন্দ্ব
এই সংঘাতের পেছনে একাধিক স্তরের কারণ আছে—রাজনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত, এমনকি মানসিকও।
টিটিপি’র আশ্রয় ও পাকিস্তানের উদ্বেগ
টিটিপি বা ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ হচ্ছে পাকিস্তানি তালেবানদের সংগঠন, যারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। তারা আফগান তালেবানের আদর্শ অনুসরণ করে, কিন্তু কার্যত পাকিস্তানের শত্রু।
পাকিস্তান বলছে, আফগানিস্তান এই টিটিপি নেতাদের আশ্রয় দিচ্ছে। এমনকি পাকিস্তান দাবি করেছে, টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদ কাবুলে অবস্থান করছে।
অন্যদিকে, আফগান তালেবান বলছে—তারা কোনো বিদেশি গোষ্ঠীকে সন্ত্রাস চালাতে দিচ্ছে না, বরং আলোচনা ও শান্তি চায়। কিন্তু তাদের কথায় পাকিস্তানের ভরসা নেই।
সীমান্ত নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক
ডুরান্ড লাইন আজও দুই দেশের মধ্যে ‘অমীমাংসিত ক্ষত’। আফগান সরকার কখনো এটিকে বৈধ সীমান্ত বলে স্বীকার করেনি। ফলে সীমান্তে চেকপোস্ট তৈরি, দেয়াল নির্মাণ বা পাহারা—সবকিছুই উত্তেজনার জন্ম দেয়।
গ্রামের মানুষও সীমান্তের দুই পাশে যাতায়াত করে, আত্মীয়তা বজায় রাখে—তাদের জীবনযাপনও রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ নীতি
পাকিস্তানের সামরিক কৌশল অনেক বছর ধরে বলে আসছে—যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লাগে, তাহলে আফগানিস্তান তাদের ‘ব্যাকআপ অঞ্চল’ হিসেবে কাজ করবে। এজন্য তারা আফগানিস্তানে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার রাখতে চেয়েছে।
কিন্তু এখন তালেবান সরকার সেই নীতি মানছে না। তারা পাকিস্তানের বদলে নিজস্ব স্বার্থে চলছে।
তালেবানরা চাইছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বিদেশি বিনিয়োগ ও ভারত–ইরান–চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। এজন্য তারা পাকিস্তানের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকতে চায় না।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট
পাকিস্তান এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, জনগণের অসন্তোষ—সব মিলিয়ে তারা বিপর্যস্ত। সেনাবাহিনীর প্রভাব কমছে, বেসামরিক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় সীমান্তে উত্তেজনা অনেক সময় “ভেতরের সমস্যা ঢাকার উপায়” হিসেবেও ব্যবহার হয়। অর্থাৎ, বাইরের শত্রু দেখিয়ে ভেতরের বিভাজনকে ঢেকে রাখা।
ভারতের নীরব উপস্থিতি, সক্রিয় কৌশল
এই সংঘাতে ভারত সরাসরি পক্ষ না হলেও, পরোক্ষভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ ও প্রভাব
গত দুই দশকে ভারত আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দিয়েছে। তারা রাস্তা, বাঁধ, হাসপাতাল, স্কুল, সংসদ ভবন পর্যন্ত তৈরি করেছে। কাবুলের মানুষ ভারতকে বন্ধুর চোখে দেখে।
তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর ভারত কিছুটা দূরে সরে গেলেও, এখন আবার ধীরে ধীরে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। কাবুলে ভারতের ছোট দূতাবাস আবার খুলেছে, এবং সম্প্রতি তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ভারতে সফর করেছেন।
তালেবান জানে—তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে ভারতের মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের সমর্থন দরকার। তাই তারা কৌশলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।
ভারতের স্বার্থ
ভারতের জন্য আফগানিস্তান কেবল একটি পার্শ্ববর্তী দেশ নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সংযোগস্থল। তাই আফগানিস্তানে কী ধরনের সরকার গঠিত হচ্ছে, কার প্রভাব সেখানে বেশি—এগুলো ভারতের কৌশলগত চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
ভারত চায়, আফগানিস্তানে এমন একটি সরকার টিকে থাকুক, যারা পাকিস্তানের ছায়ার বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কারণ ইতিহাস বলছে, আফগানিস্তানে যখনই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটেছে, তখন তার প্রভাব সরাসরি কাশ্মীর পর্যন্ত পৌঁছেছে। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া জঙ্গি অবকাঠামো পরবর্তী সময়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তালেবান পুনরুত্থানের পর সেই আশঙ্কাই আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে।
ভারতের কাছে আফগানিস্তান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে কৌশলগত—এটি মধ্য এশিয়ার বাজারে প্রবেশের গেটওয়ে। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমদিকে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয়, আফগানিস্তান ও ইরান হয়ে মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যিক করিডর তৈরির স্বপ্ন ভারত দীর্ঘদিন ধরে লালন করছে। চাবাহার বন্দর এবং ভারত–ইরান–আফগানিস্তান ট্রানজিট করিডর প্রকল্প সেই স্বপ্নেরই অংশ। তাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীল সরকার মানে ভারতের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ, জ্বালানি পরিবহনের পথ, এবং আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
এর পাশাপাশি, আফগানিস্তানে ভারতের উন্নয়ন সহায়তা—স্কুল, হাসপাতাল, পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণ—এই সব বিনিয়োগ কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে ‘সফট পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। কিন্তু তালেবান সরকারের অধীনে এই প্রভাব অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। ফলে ভারত এখন একধরনের দ্বৈত কূটনীতি অনুসরণ করছে—একদিকে তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়ে দূরত্ব বজায় রাখছে, অন্যদিকে পরোক্ষ যোগাযোগ রেখে ভবিষ্যতের সুযোগ হাতছাড়া না করার কৌশলও নিচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ তিনটি স্তরে—নিরাপত্তা (কাশ্মীর ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা), অর্থনীতি (মধ্য এশিয়া ও জ্বালানি বাজারে প্রবেশ), এবং কূটনীতি (আঞ্চলিক প্রভাব রক্ষা)। আর এই তিন দিক থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের স্বার্থ প্রায় বিপরীতমুখী।

সাম্প্রতিক ভারত সফরে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ।। ছবি:আরএনএমিডিয়া.ইন
তালেবানের স্বার্থ
বর্তমান তালেবান সরকার এখন এক কঠিন ভারসাম্যের খেলা খেলছে। তারা একদিকে কট্ট্রর ইসলামী শাসনে বিশ্বাসী, অন্যদিকে বাস্তব রাজনীতিতে টিকে থাকতে আন্তর্জাতিক সমর্থনও দরকার।
তাদের মূল লক্ষ্য এখন তিনটি-
১. শাসন টিকিয়ে রাখা – আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পেলেও নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখা।
২. অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়া – ভারতের মতো দেশকে কাছে টেনে অর্থনীতি সচল করা।
৩. স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখা – পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত থেকে ‘নিজস্ব আফগান স্বার্থ’ চালিত হওয়া।
এই স্বার্থের কারণেই আজ তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নামতেও পিছপা হচ্ছে না।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: শান্তি না আগুন?
পাকিস্তান–আফগান সংঘাত এখন এমন এক পথে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ নতুন মোড় আনতে পারে।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি
একটি সম্ভাবনা হলো—কাতার, চীন, তুরস্ক কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশগুলো মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেবে। ইতিমধ্যেই কাতার ও চীন আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে ভূমিকা রাখছে। তারা যদি তালেবান ও পাকিস্তান—দুই পক্ষকে এক টেবিলে আনতে পারে, তাহলে সাময়িক যুদ্ধবিরতি স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
তবে এই আশার পেছনে বাস্তবতা জটিল। তালেবান এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, আর পাকিস্তানও অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছে। দুই দেশই নিজেদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে অতি সংবেদনশীল। ফলে কোনো মধ্যস্থতাকারী দেশই সহজে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে না। ইতিহাস বলছে—এই দুই দেশের পারস্পরিক সন্দেহ এতটাই গভীর যে, বাহ্যিক চাপ থাকলেও শান্তি চুক্তি টেকসই হয় না। তবুও, যদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ে, তবে উভয়পক্ষই হয়তো কোনো নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় অন্তত সীমান্তে যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে।
সীমান্তে স্থায়ী সংঘর্ষ
সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও সম্ভাব্য দৃশ্য হচ্ছে—এই সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে সীমান্তে ছড়িয়ে পড়বে। কখনো গুলি বিনিময়, কখনো সীমান্ত পোস্টে হামলা, আবার কখনো মুখে মুখে কূটনৈতিক বিরোধ—সব মিলিয়ে একধরনের ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতি গড়ে উঠতে পারে।
এমন অবস্থা উভয় দেশেরই পরিচিত। ডুরান্ড রেখা (Durand Line) নিয়ে বিরোধ এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। তালেবান কখনোই এই সীমান্তকে বৈধ স্বীকার করেনি, আর পাকিস্তান তা তার সার্বভৌম সীমারেখা হিসেবে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তাই, সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষই হয়তো ভবিষ্যতের স্থায়ী বাস্তবতা হয়ে উঠবে—যেখানে যুদ্ধ না থাকলেও শান্তিও নেই।
এই ধরনের উত্তেজনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সেনাবাহিনী ও সরকার হয়তো অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ঢাকতে ‘বাহ্যিক শত্রু”র ইস্যু ব্যবহার করবে, আর তালেবান সরকারও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ঠেকাতে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগাবে। ফলে সীমান্তের সংঘাত দুই দেশের রাজনীতিতেও টিকে থাকবে।
বড় আকারের সামরিক সংঘাত
তৃতীয়, এবং সবচেয়ে ভয়ংকর সম্ভাবনা হলো—সংঘাতটি বড় আকারের সামরিক অভিযানে রূপ নিতে পারে। যদি পাকিস্তান সীমান্তে তালেবান অবস্থানকে সরাসরি লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা বা স্থল অভিযান চালায়, অথবা তালেবান প্রকাশ্যে টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)-কে রক্ষা ও সমর্থন দেয়, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এই ধরনের সংঘাত কেবল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। কারণ, আফগানিস্তান সীমান্তে বড় সংঘাত মানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নতুন করে শরণার্থী ঢল, অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান। অপরদিকে, তালেবানও আফগান জনগণের মধ্যে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা’র নামে নতুন এক জিহাদি উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে, যা গোটা অঞ্চলে নিরাপত্তাজনিত নতুন উদ্বেগ তৈরি করবে।
তাছাড়া চীন, ইরান, রাশিয়া ও ভারতের মতো শক্তিগুলোকেও এই সংঘাতের ভেতরে টেনে আনতে পারে। বিশেষ করে চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, কিন্তু আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করছে খনিজ ও অবকাঠামো খাতে। বড় যুদ্ধের ফলে সেই বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
রাজনৈতিক সংলাপের পথ
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক, যদিও এখনো দূরের সম্ভাবনা—তা হলো রাজনৈতিক সংলাপ। যদি তালেবান সরকার বুঝতে পারে যে, সীমান্ত সংঘাত ও টিটিপি’র মতো গোষ্ঠীর আশ্রয় দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বৈধতা আরও কমছে, আর পাকিস্তানও উপলব্ধি করে যে সামরিক সমাধান ব্যর্থ হচ্ছে—তাহলে হয়তো তারা আলোচনার পথে ফিরতে পারে।
এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান। যদি দুই দেশ একসাথে বসে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে পারে, যেখানে টিটিপি সদস্যরা সীমান্তের ভেতর ‘নিরস্ত্র’ হয়ে নাগরিক জীবনে ফিরে আসতে পারে, তাহলে এটি এক বড় মোড় হতে পারে। তবে এটি কেবল তখনই সম্ভব, যখন উভয় সরকারই অভ্যন্তরীণ চাপ সামলে আলোচনার জন্য রাজনৈতিক সাহস দেখাবে।
বর্তমানে সেই সাহস বা আস্থা কোনো পক্ষেই দেখা যাচ্ছে না। তাই এই পথ এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে।




























