
সঞ্জীব চৌধুরী (১৯৬৪-২০০৭)
এই নষ্ট শহরে
নাম না জানা যেকোনো মাস্তান
এই নষ্ট শহরে
নাম না জানা যেকোনো মাস্তান
সকালে ঠিক খিস্তি-খেউর, রাজা-উজির মেরে
মাস্তানি সব সেরে
বিকেল বেলা তোমার বাড়ির লাগোয়া পথ ধরে
যাচ্ছে যখন ফিরে
ভুলে না হয় দিয়েই ছিলো শিস, হাত ছিলো নিশপিশ
ছুঁড়ে না হয় দিয়েই ছিলো চিঠি
স্বীকার করে বলি
এসব কান্ড খারাপ ছেলে করে
আর স্বীকার করে বলি
এসব কান্ড খারাপ ছেলে করে
তবু মেয়ে, প্রেম তবু তার মিথ্যে ছিলো না
মিথ্যে ছিলো না
ফরহাদ মজহারের লেখা এই কবিতাটিকে গান বানিয়েছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। কিশোর বয়সে ছাত্র ইউনিয়ন করা সঞ্জীব বোর্ড স্ট্যান্ড করে বুয়েটে ভর্তি না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হলেন। সেখান থেকে আবার চলে এলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে।
সঞ্জীব এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তুমুল শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। খান মোহাম্মদ ফারাবী’র (১৯৫২-১৯৭৪) কবিতা থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে নিজে লিখতে শুরু করেছিলেন। সেটা ১৯৮০ সালের কথা।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে তাঁর চিন্তার আরো উন্মেষ ঘটলো। তিনি গান করতেন। সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হলো। এরপর তাঁর হাত দিয়ে বাংলাদেশের ফিচার সাংবাদিকতা পৌঁছে যায় অনন্য মাত্রায়।
তবে সঞ্জীব মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই। বাপ্পা মজুমদারকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘দলছুট’। সঞ্জীব ‘ব্যান্ড’ করলেন। কিন্তু ‘রক’ এর পথে গেলেন না। তিনি আশ্রয় করলেন ফোক আর ক্ল্যাসিকালকে। কখনো কখনো কিছুটা মেলো-রক।
তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ!’ (১৯৯৭)। অ্যালবামের ফোকধর্মী ‘সাদা ময়লা রঙিলা পালে’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। সঞ্জীব তারকাখ্যাতি পেলেন। এরপর ২০০০ সালে ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামটি দলছুটকে ব্যাপক পরিচিতি দিলো। শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটিকে পপ ধাঁচে গেয়ে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন সঞ্জীব। এই অ্যালবামের প্রায় সব গানই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ‘চল বুবাইজান’ এর মতো চমৎকার ফোক-রক ধাঁচের গানও উপহার দেন সঞ্জীব।
২০০২ সালে তাদের তৃতীয় অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’ প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামটিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কামরুজ্জামান কামু’র কথায় সঞ্জীব গান ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি, দু হাতে আগুন তারও/ কার মালা হতে খসে পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়/ কার হাতখানি পুড়ে গেল বধূ/ আঁচলে তাহারে ঢাকো/ আজও ডানাভাঙা একটি শালিক- হৃদয়ের দাবি রাখো।’
এই অনন্য গীতিকবিতাটি বিশ্লেষণের নয়, বরং অনুভবের। একেকজন একেকভাবে নিজের সাথে মেলাতে বা রিলেট করতে পারবে।
এরপর ‘জোছনাবিহার’ (২০০৭)-সহ আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ পায় দলছুটের।
২০০৫-এ সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’ প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামেই ছিলো সঞ্জীবের সেই আলোচিত গান- ‘স্বপ্নবাজি’।
ওরা বলে ঐ গাড়িতে করে আমাদের জন্য
খাদ্য আর পানীয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো
আমাদের জন্য খাদ্য আর পানীয়।
কিন্তু বিশ্বাস করুন বন্ধুগণ
আমি জানি ঐ গাড়িতে আমাদের জন্য
কোন খাদ্য ছিলো না,
আমাদের জন্য কোন পানীয় ছিলো না।
তিনশটি লাশ, তিনশটি লাশ ঠান্ডা হিম
যাদের গুম করে ফেলা হবে।
আমি বলতে চেয়েছিলাম সেই সমস্ত কথা।
আর তখনই, তখনই আমার দিকে এগিয়ে আসলো উদ্ধত রাইফেল
আমার দিকে এগিয়ে আসলো উদ্ধত বেয়নেট।
ওরা বলে, “খামোশ!”
পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক
আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি
ওহো শান্তি রক্ষিত হোক।
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন।
আমাকে চুপ করতে হয়, আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়
তবু, তবু বন্ধুগণ……
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই
আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।
সঞ্জীবের লেখা এই গানটিতে শহীদ তাজুল ইসলাম কিংবা কর্ণেল তাহেরের প্রসঙ্গও আছে।
২০০৫ এ এই গান টিএসসিতে গেয়ে সঞ্জীব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তবে সে বছরই ‘দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকা’ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে সঞ্জীব বেকার হয়ে পড়েন।
গান নিয়ে তার ব্যস্ততা ছিলো। এর বাইরে ‘রাশপ্রিন্ট’ সম্পাদনা করতেন। তবে মৃত্যুর আগে আর কোথাও পূর্ণকালীন কাজ করা হয়নি তাঁর।
এর ভেতর ২০০৭ সালে আবারও দেশে সামরিক শাসন এলো। ৯১-০৬ এর সময়ের দলীয়করণ, ০৭ এর সামরিক শাসন, সাংবাদিকতার পেশা হয়ে না ওঠা, শিল্পের কর্পোরেট পণ্যায়ন – এই সবকিছু সঞ্জীবের হতাশা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলছিল।
এ সময়ে রাশপ্রিন্টে লিখে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর অন্তর্গত দহনের কথা। তিনি লিখেছিলেন: ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্রাকের চাকার নিচে ফেটে যাওয়া দিপালী সাহার হৃদপিন্ডকে যারা ভ্যালেন্টাইন-বেলুন বানিয়ে বেচে দ্যায়, অথবা যাদের শুধুমাত্র শরৎবাবুই কাঁদাতে পারেন, একমাত্র গোপাল ভাঁড়ই হাসাতে পারে- সেই নিথর স্বাভাবিকতায় মৃত মানুষদের ব্যবচ্ছেদ ঘটে এক নীল ক্লিনিকে।’
সঞ্জীব চৌধুরী স্ট্রোক করেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবে সেদিন টালমাটাল দেশ। তার চারদিন পর ১৯ নভেম্বর, ২০০৭- অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন সঞ্জীব। বয়স তখন ৪৩ পূর্ণ হয়নি।
সঞ্জীব চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর গান-কবিতা। তাঁর গান শ্রোতাদের কানে আজও বাজে: ‘কান্নার রং আর জোছনার ছায়া’ হয়ে। সঞ্জীব তাঁর ‘সমুদ্র-সন্তান’- এ লিখেছিলেন: ‘আকাশজুড়ে শঙ্খচিলের শরীর চেরা কান্না থামাও/ সমুদ্র কি তোমার ছেলে, আদর দিয়ে চোখে মাখাও…’
এখনো মানুষের হাহাকার নানাভাবেই বর্তমান আছে। হয়ত সবসময়ই থাকবে। আর সেই হাহাকার কণ্ঠে ধারণ করে চিরঞ্জীব হয়ে রয়ে যাবেন সঞ্জীব চৌধুরী।




























