শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় বিনোদন ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২:৪৫ অপরাহ্ন
শেয়ার

সদরুল পাশা: ক্ষণজন্মা অসামান্য এক প্রতিভা


Sodrul Pasa Cover

“হিপোক্রিট, আমরা সবাই দারুণ হিপোক্রিট হে অনাদি। মানুষ মাত্রই গ্রেট অভিনেতা আর এই দুনিয়াটা একটা রঙ্গমঞ্চ। ভিতরে বাইরে আমরা নিজের সঙ্গে পরের সঙ্গে দিবারাত্র অভিনয় করছি। মুখে চুন কালি না মেখে আমরা প্রতিা মুহূর্তে রাজা সেজে, ভিখিরি সেজে, কতবার রাণী সেজে, ভালবাসার কথা, মহত্ত্বের কথা, দারিদ্রের কথা বলি- যেন সব সত্যি। ছি ছি। অথচ আমরা যারা নাটকের পাগল, মঞ্চের লোক তারা কনসার্ট আর ব্যাগ পাইপ সাজিয়ে যখন অ্যাকটিং করি, অনুকরণ করি, রঙ্গব্যঙ্গ করি তাই দেখে তোমাদের জ্ঞানবান, বিত্তবান ভণ্ড মূর্খের দল কত হাসে, ঢলাঢলি করে, আহাজারি করে। তারপর এই কালো ড্রপসিনটা পড়লে বিড়ালের মতো মোঁচ মুছতে মুছতে ও বউ-ছেলের হাত ধরে ঘরের দিকে ধাবমান হয়, যেন কত কত সাধু পুরুষ। ভাজা মাছটি কেউ উল্টে খেতে জানে না, পুত পবিত্র চরিত্রবান একেকজন। আর আমরা, যারা ড্রপসিনের এই ধারে জঠরের কামড়ে হুমড়ি খেয়ে, মঞ্চের পাটাতনে পড়ে থাকি, তখন কেউ কি এসে বলে যামিনী বাবু আপনি তো অভিনয় করেন নি, যা সত্য যা গোপন তাকে সবার চক্ষে উন্মোচন করেছেন, চলুন। কেউ বলে? সাহস করে কোন জ্ঞানী কোন ধনী সত্য কথা বলতে পারে না। বলে না অনাদি, বলবার মত সাহস নাই কোন হিপোক্রিটের।”

মমতাজউদ্দীন আহমদের ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ নাটকের সংলাপ এটি। সত্তর দশকে চট্টগ্রামের সেন্ট মেরিজ হলে প্রদর্শিত হলে নাটকটি ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। এই নাটকের মুখ্য চরিত্র যামিনীভূষণ রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন সদরুল পাশা।

চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। কিশোর বয়স থেকেই যুক্ত হন নাটকের সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে ‘থিয়েটার ৭৩’ এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে শিশির দত্তকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়।’ এটি চট্টগ্রামের তৃতীয় প্রাচীন নাট্যদল। অরিন্দমের নাটক সে সময় চট্টগ্রামে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, টিকেট কালোবাজারীর মতো ঘটনাও ঘটেছিল।

চিকিৎসক পিতার সন্তান সদরুল পাশা ভর্তি হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজেই। কিন্তু ততদিনে ভালোবেসে ফেলেছেন চলচ্চিত্রকে। পিতার অমত ছিলো, কিন্তু তিনি ততদিনে পুনেতে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে স্কলারশিপ পেয়ে গেছেন। তার পিতাকে রাজি করানোর দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী। ১৯৭৬ সালে ফিল্ম নিয়ে পড়তে পুনেতে রওনা হন সদরুল পাশা।

এরপর পুনেতে খ্যাতিমান অনেক চলচ্চিত্রকারদের সাথে তার পরিচয় হয়। সে সময়টায় জীবনে আসে প্রেমও। ব্যারিস্টার আনিজকে বিয়ে করেন। ১৯৭৯ সালের দিকে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে বোম্বেতে বেশ পরিচিত পান। প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছিলেন তিনি বোম্বেতেই থেকে যাবেন।

সে সময় খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূনও ভার‍তে লেখাপড়া করছিলেন। তিনি ও সদরুল পাশা একদিন প্রখ্যাত নাট্যদল নান্দীকার-এর অফিসে যান। সেখানে ছিলেন দলের প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। সদরুল পাশার মাথায় তখন সিনেমা। তার কাছে স্ক্রিপ্ট চেয়ে বসেন তিনি। রুদ্রপ্রসাদ নান্দীকারের জনপ্রিয় নাটক ‘ফুটবল, ফুটবল’ এর স্ক্রিপ্ট সদরুল পাশাকে দেন। কিন্তু ট্রাম থেকে নেমে কিছুদূর গিয়েই পাশার মনে পড়ে, স্ক্রিপ্টটা তিনি ট্রামেই ফেলে এসেছেন! স্ক্রিপ্টটি আর পাওয়া যায়নি। সিনেমাটিও আর বানানো হয়নি।

Sodrul Pasa-3

বন্ধু খ ম হারূনের সাথে সদরুল পাশা

পরবর্তীতে পাশা দেশে ফেরেন। সেটা ১৯৮৩ সালের শেষদিকের কথা৷ এরপর ঠিক করেন ঢাকায় থাকবেন। সিনেমা করার ব্যাপারটা তার মাথায় ছিলো, তবে পেশাগতভাবে বেছে নেন বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে। ‘সৃষ্টি’ নামে একটি অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনে সিনেমাটিক এসেন্স আনার মূল পথিকৃৎ তিনি। এর ফলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনে কনসেপ্ট ও স্টোরিটেলিং অনন্য মাত্রা পায়। আজ বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগত যে জায়গায় আছে, তার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি।

নাটকেও অভিনয় করেছিলেন সদরুল পাশা। ‌‘সাগর সেচার সাধ’, ‘ধবলার চর’ কিংবা ‘নীল পানিয়া’র মতো অনন্য কাজ রয়েছে তার। ‘সাগর সেচার সাধ’ নাটকে নাহিদ ফেরদৌস মেঘনা’র বিপরীতে তার অনবদ্য অভিনয় নাটকটিকে বিটিভির সে সময়ের অন্যতম আলোচিত নাটকে পরিণত করে। এর বাইরে আরো কিছু নাটকে কাজ করেছেন সদরুল পাশা।

ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ ছিলেন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়৷ তখন চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য তিনি প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। যদিও ঠিক তখনই যেতে পারেননি, কিন্তু চট্টগ্রাম ছিলো তার শেকড়, তার ভালোবাসার জায়গা।

বিজ্ঞাপন জগত কিংবা টিভি নাটকে তার সরব উপস্থিতি থাকলেও তিনি তার ভালোবাসার জায়গা মঞ্চে নানা কারণেই ফিরতে পারেননি। এক্ষেত্রে ব্যস্ততার চেয়েও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অসহযোগিতা। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবার কথা ছিল, কিংবা যাদের আপন মনে করতেন, তারা অনেকেই তখন তাকে আর মঞ্চের মানুষ বা নিজেদের লোক বলে ভাবতে পারেননি৷ এ নিয়ে মনোকষ্ট ছিল তার।

Sodrul Pasa-2

সদরুল পাশা

১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সদরুল পাশার মৃত্যু হয়। তার জীবনের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায় অরিন্দম নাট্য গোষ্ঠীর ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ নাটকের একটি অংশের। সেটি উল্লেখ করেই লেখাটি শেষ করা যাক:

“ভাবব না? অনাদি, আমি থিয়েটারের কথা ভাবব না কেন বলতো? ওহো বুঝেছি আমি তো এখন তোমাদের সবার কাছে বাতিল। আমার সেই শরীর নাই, শক্তি নাই, চেহারাতে জৌলুশ নাই। এ কালের কোন একটা নাটকে মৃত সৈনিকের চরিত্রটাও আমার জন্য কেউ বরাদ্দ করবে না তাই না। হায়রে মানুষ, আর মানুষের কাল। অথচ এই মঞ্চের দেয়ালের দিকে আমি যখন তাকাই, আমার কি মনে হয় জান, এখানে এই দেয়ালের প্রত্যেকটি ইটের বুকে আমার জীবন পাতার প্রত্যেকটি বর্ণ রক্ত দিয়ে, আনন্দ দিয়ে বেদনা দিয়ে কে যেন লিখে দিয়েছে অনাদি, আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের থিয়েটারের জীবন কালো অঙ্গারে লেখা হয়ে গেছে। আমার সমস্ত জীবন অনাদি। হায়রে জীবন তুমি থিয়েটারে পড়ে আছ কেন বলতো। থিয়েটারকে ভালবাস, মা যেমন সন্তানকে ভালবাসে, ভক্ত ভগবানকে- নাকি প্রজাপতি যেমন ফুলকে?”