
‘সেই যে চলে গেলে, আর হায় এলে না ফিরে/ কত যে খুঁজেছি তোমায় অকারণ অশ্রুজলে’ কিংবা ‘যখনি নিবিড় করে পেতে চাই তোমাকে, তখনই দু চোখ বুজি আমি/ নয়নে স্বপ্ননে দেখি শুধু তোমায়, বিরহ বরষায় মেঘেরই ছায়ায়’- এই গানগুলো হয়ত এ প্রজন্মের কাছে অনেক বেশি পরিচিত নয়। তবে রক মিউজিকের খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা শুনে থাকতে পারেন গান দুটি। এই গানগুলোর শিল্পী নিলয় দাস। অনুরাগীদের কাছে প্রিয় ‘নিলয় দা’।
তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের গিটারিস্টদের গিটারিস্ট। ইব্রাহীম আহমেদ কমল (ওয়ারফেইজ), রেদওয়ান চৌধুরী পঞ্চম (আর্ক), রোমেল আলী (ওয়ারফেইজ), বাপ্পা মজুমদার (দলছুট), সুমন (অর্থহীন), বুনো (বাংলা)-সহ দেশের বহু গিটারিস্ট রয়েছেন, যারা তার কাছে সরাসরি শিখেছেন।

গিটার হাতে নিলয় দাশ ।। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ
নিলয় দাশ নিজে ছিলেন বোহেমিয়ান, বৈষয়িক নন। বহু গিটারিস্টকে বিনামূল্যে গিটার শেখাতেন। ভালোবাসতেন রাত জাগতে। সারারাত জেগে সকালে ঘুমাতেন, সন্ধ্যায় উঠতেন। একারণে তার গানের রেকর্ডিং সবসময়ই হতো রাতে। এরকমই একবার তার বন্ধু সুরকার আশিকউজ্জামান টুলুর সাথে রাতে গান রেকর্ড করে কমলাপুরে শ্রমজীবী মানুষদের সাথে অনেক রাতে ভাত-কালাভুনা খেয়েছিলেন তারা। নিলয় বাঁধাধরা জীবন পছন্দ করতেন না।
একসময় কিছুকাল শিল্পকলা একাডেমীতে গিটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। ট্রিলজি নামে ব্যান্ড ছিলো তার। পরে সলো ক্যারিয়ারেই ছিলেন। ‘সেই যে চলে গেলে’ কিংবা ‘যখনি নিবিড় করে’র মতো বিখ্যাত গানগুলো সুর করেছিলেন ফোয়াদ নাসের বাবু। এর বাইরে আশিকউজ্জামান টুলুর সুরে ‘বিবাগী রাত’ নামে অ্যালবাম করেছিলেন নিলয়। সেখানে মহীনের ঘোড়াগুলির ‘হায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন নতুন আঙ্গিকে।

নিলয় দাশের অ্যালবাম ‘বিবাগী রাত’ (১৯৯২) এর কভার
এর বাইরে কিছু মিক্সড অ্যালবামে গান করেছেন। এর ভেতর আইয়ুব বাচ্চুর সুরে ‘এ শহর ডুবে যায়’ বাংলা ব্লুজের অনন্য এক উদাহরণ। এর বাইরে ‘লাশকাটা ঘর’র মতো হরর গানও করেছেন তিনি৷ এরকম গান বাংলায় খুব বেশি নেই। এছাড়া তার অকালপ্র্য়াত বন্ধু আরেক কিংবদন্তী গিটারিস্ট ও শিল্পী হ্যাপি আখন্দের স্মরণে গেয়েছিলেন ‘হ্যাপি তোকে মনে পড়লেই’।
নিলয় দাশের হাত ধরেই বাংলায় কান্ট্রি মিউজিক, ব্লুজ, রক, জ্যাজ, ফ্লামেনকো অন্যমাত্রা পায়। বিশেষত স্প্যানিশ ফ্লামেনকো মিউজিককে বাংলা ভাষায় প্রথম নিয়ে আসেন তিনিই।

তরুণ বয়সে নিলয় দাশ ।। ছবি: সংগৃহীত
নিলয় দাশ প্রচলিত অর্থে কোনো সেলিব্রেটি ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ভবনের সামনে কিংবা ঢাকার আরো নানান রাস্তায় তাকে দেখা যেত গিটার হাতে বসে আছেন। নিজের মতো করে জাদুকরী সুর বুনে চলেছেন গিটারের ছয় তারে। ইব্রাহীম আহমেদ কমল এমন এক দিন আইবিএ-র সামনে তার বাজনা শুনে ধরতেই পারছিলেন না তিনি কোন প্যাটার্নের গিটার রিদম প্লে করছেন। নিলয় মূলত ছিলেন নিওক্লাসিক্যাল গিটারিস্ট। রাতের পর রাত জেগে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিংক ফ্লয়েড, লেড জ্যাপেলিন, ঈগলস, কুইন, নির্ভানা শুনতেন। জিমি হেনড্রিক্সকে গুরু মানতেন। অনুসরণ করতেন রিচি ব্ল্যাকমোর, র্যান্ডি রোডসের মতো গিটারিস্টদের। তার ‘যখনি নিবিড় করে’ গানটি তার নিওক্লাসিক্যাল গিটার দক্ষতার এক অনন্য স্মারক।
লেখক ও কিউরেটর এবাদূর রহমানও তার পরিচিত ছিলেন। এক টঙ দোকানে একবার তিনি আর নিলয় দাশ বসেন। নিলয় দাশের সাথে গিটার সবসময়ই থাকত। গরম তেলে পুরি-সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে, আর এদিকে নিলয় দাস গিটারে টুং-টাং করে বাজাতে শুরু করেছিলেন ফ্লামেনকোর সুর। উৎসুক মানুষ মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে, ক্যাপ পরা একটা লোক অদ্ভুত এক সুর বাজিয়ে চলেছে অবলীলায়। হাতে স্লাইডারও পরা নেই, কিন্তু না, নোট মিস হচ্ছে না একটাও। সম্মোহিতের মতো স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে কেউ কেউ। কিন্তু কেউ চেনে না এই লোকটা কে!
ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী যথার্থই বলেছিলেন, ‘নিলয় গিটারবাদক নয়, সে গিটারসাধক।’

কনসার্টে গিটার হাতে গাইছেন নিলয় দাশ ।। ছবি: সংগৃহীত
নিলয় দাশ শিক্ষাগুরু হিসেবে বহুজনকে যেমন শিখিয়েছেন, তাদের ক্যারিয়ারের ভিত গড়েছেন, তেমনি তার জীবনে আবার নেমে এসেছিল হতাশার কালো ছায়া। সেসব কেটে বেরিয়ে এসেছিলেন, আবার শুরু করেছিলেন অ্যালবামের কাজ। কিন্তু এলবামের ৭০ ভাগ কাজ যখন শেষ, তখনই ঘটলো ঘটনাটা! হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন নিলয় দাশ। ২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি প্রচণ্ড এক শীতের ভোরে অনন্তলোকে পাড়ি জমান তিনি। মৃত্যুর আগেও ডাক্তারকে তিনি বলেছিলেন- ‘আমার বাম হাতে অন্তত স্যালাইন দেবেন না, তাহলে আর গিটার বাজাতে পারবো না।’
মাথায় ক্যাপ, হাতা গোটানো ফুল শার্ট আর হাতে ধরা গিটার- নিলয় দাশের ট্রেডমার্ক, ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ
১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন নিলয় দাস। পিতা নজরুল সঙ্গীত গবেষক ও সঙ্গীতজ্ঞ সুধীন দাশ, মা নীলিমা দাশ। বেঁচে থাকলে আজ ৬৪ বছর পূর্ণ করে ৬৫ তে পা রাখতেন তিনি। তবে তার বহু আগেই ৪৪ বছর বয়সেই মুছে গিয়েছিল সব নিলয়ের রং!
তার বিষয়ে তার বন্ধু ও প্রখ্যাত গিটারিস্ট-সুরকার-সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘নিলয় ওয়াজ দ্য গ্রেটেস্ট নিওক্লাসিক্যাল গিটারিস্ট অব আওয়ার টাইম। কিন্তু ওকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। ওর অভিমান নিয়ে ও চলে গেছে।’



























